“ স্যার ‘’ সম্বোধন এবং….

প্রকাশিত: ২:১৬ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৩, ২০২৩

“ স্যার ‘’ সম্বোধন এবং….

 

আমিনুল ইসলাম

 

কোন্ কোন্ পেশার লোককে “ স্যার “ সম্বোধন করতে হবে আর কোন্ কোন্ পেশার লোককে “ স্যার’’ সম্বোধন করা যাবে না, তাই নিয়ে বেশ কিছু স্ট্যাটাস দেখছি গতকাল থেকে। অধিকাংশ স্ট্যাটাস খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির চিহ্ন বহন করে। স্ট্যাটাস-দাতাকেও বুঝতে হবে যে— সব পেশার লোকই এদেশের মানুষ, সবাই বৃহত্তর জনগণের অংশ, সবাই করদাতা। সবার বেতনভাতাতেই সবার অবদান আছে। যাদের জনগণ বলা হচ্ছে তারাও অন্যদের শ্রম, সেবা ও কর থেকে সুবিধা পেয়ে থাকেন। সবাইকে নিয়েই “ জনগণ ’’।
“পেশাগত মহত্ব আরোপ’’ একটি সুবিধাবাদী ভাবনা ছাড়া আর কিছু নয়। সকল চাকরিজীবী পেশার লোকই বেতনাভাতা অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগার অথবা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে। তারা কেউই “ নিঃস্বার্থভাবে’’ সেবাদান করে না। সকল চাকরিজীবী পেশার মানুষই টাকার বিনিময়ে শ্রম বিক্রি করে। প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরি হলে এখন প্রায় সবাই “ ক্যাডার সার্ভিস ’’।
এখনকার চাকরিজীবীরা কেউই মাদার তেরেসার বা প্রাচীনযুগের শিক্ষাগুরুর আদর্শ বহন করে না। আপনি টাকার বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় / প্রাতিষ্ঠানিক সেবা বা শিক্ষা দিয়ে নিজেকে ‘‘মহত’’ দাবি করতে পারেন না। মহত হতে হলে আপনাকে বেগম রোকেয়া অথবা মাদার তেরেসা বা দইওয়ালা জিয়াউল হক অথবা বীরশ্রেষ্ঠ নুরমোহাম্মদ কিংবা বৃক্ষমানব: কার্তিক পরামানিক হতে হবে। নিজের দইকে কেউ টক বলে না; আমরা কেউই নিজ ক্যাডারে অথবা ক্যাডার বহির্ভূত নিজ পেশার দুর্বল দিকগুলো দেখতে পাই না অথবা দেখেও দেখি না। আমাদের চাকরিজীবীদের মধ্যকার সমস্ত দ্বন্দ্ব পেশাগত দ্বন্দ্ব যা হীনমন্যতা, অহংবোধ আর ঈর্ষাপরায়ণতা থেকে উদ্ভূত। এসবের সাথে সমাজের মঙ্গলের অথবা সমাজের চাহিদার কোনো সম্পর্ক নেই।
আমাদের আরও মনে রাখতে হবে কোনো পেশায় কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয় এবং কোনো পেশায় ‘‘মহত’’ বা “ অমহত ’’ নয়। সব পেশাই মহান যদি পেশাধারী লোকজন সেই পেশার পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে বা করতে পারে। একজন মেথরের কাজ কোনোভাবেই অন্য কোনো পেশার কাজের চেয়ে কম মহত নয়। একজন তাঁতির কাজ একজন শিক্ষকের বা বিচারকের বা প্রশাসকের কাজের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁতি কাপড় না বুনলে ঐ শিক্ষককে/বিচারককে/প্রশাসককে ল্যাংটা হয়ে থাকতে হবে। যে-পুলিশ রাতদিন মানুষের জানমালের “ নিরাপত্তা “ প্রদানের সাথে জড়িত, অপরাধীদের ধরে এনে বিচারে সোপর্দ করে যে, তার কাজ একজন বিচারকের অথবা অন্য পেশার লোকের কাজের চেয়ে “ কম মহত ‘’ হয় কী করে? আবার সবখানেই “ নেতিবাচক ব্যতিক্রম ‘’ আছে এবং সেসবের জন্য নানাবিধ ও নানামুখী কারণ দায়ী, তার জন্য কোনো পেশা দায়ী নয়।
পুলিশ-প্রশাসক এদের “ স্যার ‘’ ডাকা যাবে না । মানলাম। কিন্তু “স্যার ‘’ সম্বোধন যদি ‘‘শিষ্টাচার’’ এর অংশ না হয়ে সত্যিসত্যি ‘‘ দাসত্ব’’ এর চিহ্ন হয়, তবে ছাত্রছাত্রী তাদের শিক্ষকদের “ স্যার’’ ডাকবে কেন? ছাত্রছাত্রীরা কি শিক্ষকদের দাস বা অধীনস্থ কর্মচারী? তেমনি ‘‘বিচারকদের ‘’স্যার ডাকতে হবে কেন? আমিও তো বিচারক ছিলাম বহুদিন। আমিও তো জানি– বাদী বা আসামী অথবা সাক্ষী অথবা আইনজীবী –তারা কেউই তো বিচারকের অধীনস্থ কর্মচারী নন কিংবা বিচারকের দাস নয় তারা। আর জনপ্রতিনিধিদের তো জনগণ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন। তাহলে নির্বাচক ভোটার বা জনগণ কেন মন্ত্রী-এমপি-দের “ স্যার সম্বোধন’’ করবে?
“স্যার’’ সম্বোধন যদি আপত্তিকর হয়, তবে আমি কাউকে ‘‘স্যার’’ সম্বোধন করবো না এবং আমি নিজেও কারও কাছ থেকে “ স্যার ’’ ডাক শুনবো না, এমনটা হওয়া উচিৎ আমাদের অবস্থান। এক্ষেত্রে ডাবল স্টান্ডার্ড কোনো সমাধান এনে দেবে না।
আর যদি ‘‘স্যার “ সম্বোধন শিষ্টাচার এর অংশ হয় , তবে কোনো পেশার লোককেই জ্যেষ্ঠতা ও পদমর্যাদা মেনে “স্যার” সম্বোধন করতে আপত্তি থাকার কথা নয়।
রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগ প্রদত্ত পুলিশ, সেনাসদস্য, প্রশাসক যেমন রাষ্ট্রের বেতন কোষাগার থেকে বেতনভাতা পান , শিক্ষক-বিচারক-মন্ত্রী-ডোম–চিকিৎসক তারাও তেমনি একইভাবে রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করে থাকেন। অন্যান্য চাকরিজীবীরা পান তাদের নিজনিজ নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে।
“স্যার ‘’ সম্বোধনের খণ্ডিত সমাধান দাবি করলে করা যাবে কিন্তু তা বাস্তবায়িত হবে না। কারণ সে দাবি অবাস্তব। সবচেয়ে ভালো সমধান হচ্ছে—- কলোনয়িাল বৃটিশ শাসক প্রবর্তিত “ স্যার’’ সম্বোধন’ উঠিয়ে দেওয়া। কাউকেই কারও “স্যার ‘’ ডাকার দরকার নাই। বৃটিশদের জাতিগত “সৌজন্যবোধ” আমরা পাইনি ফলে তাদের প্রবর্তিত শিষ্টাচারমূলক প্রত্যয়গুলোও আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে অপারগ।
(১) আমি স্বচক্ষে দেখেছি নিজকানে শুনেছি– অষ্ট্রেলিয়ায় নিউজিল্যান্ডে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকে–“ মি. ডেভিড’’ এমনভাবে।
(২) হযরত মুহম্মদকে সবাই “মুহম্মদ’’ নামে ডাকতো, তার স্ত্রীরাও।
(৩) ইরানে প্রেসিডেন্টকে নাম ধরে ডাকে তার অধঃস্তন কর্মচারীরাও।
(৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তাই–নাম ধরে অথবা মি. প্রেসিডেন্ট ব’লে।
“স্যার” সম্বোধন বৃটিশরা চালু করেছিল—শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, প্রশাসনে, পুলিশে, আদালতে সবখানে। এটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, সাংবাদিকতা— সবখান থেকেই উঠিয়ে দেওয়া যায় –একইসাথে। সবাই “জনাব অমুক’’ বা “ জনাব –পদবী ’’ সম্বোধনে ডাকলেই চলবে।
কোনো রোগেরই আংশিক সমাধান নাই— থাকতে পারে না; “ স্যার’’ রোগেরও নাই। বাংলাদেশের শিক্ষিত মানুষ বিশেষত পেশাজীবীদের বড় অংশটাই একইসাথে ‘‘দ্বিমুখী মানসিক জটিলতা”– “Inferiority complex ” এবং “Speriority complex “- এ ভোগেন। বৃটিশ প্রবর্তিত শিষ্টাচারমূলক ব্যবস্থা তাদের কাছে “ বানরের গলায় মুক্তার হার ‘’ । এক্ষেত্রে স্থায়ী সমাধান হচ্ছে সেসব মুছে ফেলা—-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-রাজনীতি-প্রশাসন-বেসরকারি খাত—- সকল অঙ্গন থেকে।
অতঃপর রবীন্দ্রনাথ: “ আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে..।”

আমিনুল ইসলাম ঃ কবি ও প্রজাতন্ত্রের সুশীলসেবক