যশোরের বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ শাসনকালে বিভিন্ন পর্যায়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকা লুটের তথ্য পাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ভুয়া প্রকল্প, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ বাণিজ্য ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই লুটেরা সাবেক জনপ্রতিনিধিদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে জোরালো কার্যক্রম শুরু করেছে।
দুদক যশোরের সহকারী পরিচালক মোঃ আল.আমীন জানান, সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আদালতের মাধ্যমে দুদক ইতোমধ্যে চারজন সাবেক জনপ্রতিনিধি এবং তাদের স্ত্রীদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এর মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার, সাবেক পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু এবং সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল অন্যতম। এছাড়া আরও তিনজনের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান চলছে। সর্বশেষ, যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হায়দার গনি খান পলাশের বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য : সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য এবং তার স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্য্যের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরে দুটি আলাদা মামলা হয়েছে। একটি মামলায় স্বামী-স্ত্রী উভয়কে এবং অপর মামলায় স্বপন ভট্টাচার্য্যকে একক আসামি করা হয়েছে।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম এই মামলাগুলোর তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বামী-স্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা ৫ কোটি ৫৫ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯১ টাকার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং দশটি ব্যাংক হিসাবে ১০ কোটি ৩৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫৮৩ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য গোপন করেছেন। একক আসামির মামলায় স্বপন ভট্টাচার্য্যের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৪৮ লাখ ৭১ হাজার ১৫১ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন এবং নিজ নামের ১৯টি ব্যাংক হিসাবে ৪১ কোটি ৬৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৩৪ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৭ মার্চ, দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে যশোরের সিনিয়র স্পেশাল জজ (জেলা ও দায়রা জজ) শেখ নাজমুল আলম সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য ও তার স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্য্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সম্প্রতি আরেকটি আবেদনের ভিত্তিতে একক আসামির মামলাতেও স্বপন ভট্টাচার্য্যের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞার আদেশ এবং তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন একই আদালত।
সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার : জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার, যিনি বিগত সরকারের আমলে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সপরিবারে পালিয়ে যান। একই বছরের ২৮ নভেম্বর, দুদক সদর দপ্তরের একটি দল যশোরে এসে শাহীন চাকলাদারের স্থাবর সম্পদের অনুসন্ধানে নামে। এই টিমের সদস্যরা গণপূর্ত বিভাগ থেকে প্রকৌশলী এনে শহরের চিত্রা মোড়ের জাবীর ইন্টারন্যাশনাল হোটেল ভবন ও পুরাতন কসবা কাঁঠালতলার বাড়িসহ অন্যান্য স্থাপনা পরিমাপ করেন।
গেল বছরের ১৬ অক্টোবর, আদালত শাহীন চাকলাদার, তার স্ত্রী ফারহানা জাহান মালা, ২ মেয়ে সামিয়া জাহান অন্তরা ও মাঈসা জাহান অহনা এবং ছেলে জাবীর চাকলাদারের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আস সামছ জগলুল হোসেন এই আদেশ দেন। দুদকের উপ-পরিচালক মো. শফি উল্লাহ তার আবেদনে উল্লেখ করেন, শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে শত শত কোটি টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমন রহিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
এরপর চলতি বছরের ১৭ মার্চ, যশোর-৬ আসনের সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার ও তার স্ত্রী ফারহানা জাহান মালার বিরুদ্ধে ঢাকায় আলাদা দুটি মামলা করে দুদক। শাহীন চাকলাদারের বিরুদ্ধে করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, তিনি যশোর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ৪২ কোটি ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার ৬২৩ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করে দখলে রেখেছেন। এছাড়াও তিনি ২৯টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৩৪১ কোটি ৬১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৬৫ টাকা সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। ফারহানা জাহান মালার বিরুদ্ধে করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, তিনি স্বামী শাহীন চাকলাদারের সহায়তায় ১১ কোটি ২০ লাখ ৮৫ হাজার ২২১ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন।
সাবেক এমপি রণজিৎ রায় : যশোর-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রণজিৎ রায়, তার স্ত্রী নিয়তি রাণী রায় এবং দুই ছেলে রাজীব কুমার রায় ও সজীব কুমার রায়ের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আলাদা চারটি মামলা করেছে দুদক। চার মামলায় তাদের বিরুদ্ধে ১৫ কোটি ৫৫ লাখ ৩ হাজার ২৪ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ২১৯ কোটি ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৭ টাকার সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
সাবেক পৌর মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু: জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টুও বিগত সরকার আমলে যশোর পৌরসভার মেয়র পদে থাকাকালীন বিপুল অঙ্কের অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করে দেশ-বিদেশে তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগের অনুসন্ধানে কাজ করছে দুদক যশোর। এছাড়া জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু, তার স্ত্রী শামীমা শারমিন ও ছেলে সায়েদ আনান চাকলাদারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আদালত। অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক যশোরের সহকারী পরিচালক মো. আল আমীনের করা আবেদনের প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১৫ মে সিনিয়র স্পেশাল জজ শেখ নাজমুল আলম এ আদেশ দেন।
সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল : যশোর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সাইফুজ্জামান পিকুলও সরকারি সম্পদ ব্যাপক হারে লুট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কের হাজার হাজার গাছ বিক্রি করে এবং বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এছাড়া তিনি নিয়োগ বাণিজ্য, জমি ইজারা ও দোকান বরাদ্দের মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার দুর্নীতি এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দুদক যশোর। গত ১৬ জুন, অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদক যশোরের উপ-সহকারী পরিচালক জালাল উদ্দিনের আবেদনের প্রেক্ষিতে যশোর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, তার স্ত্রী শেফালী জামান এবং দুই ছেলে তানজীব নওশাদ পল্লব ও তানভীর নওশাদ অর্ণবের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। যশোরের সিনিয়র স্পেশাল জজ (জেলা ও দায়রা জজ) শেখ নাজমুল আলম এই আদেশ দেন।
সাবেক পৌর মেয়র হায়দার গনি খান পলাশ: যশোর পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হায়দার গনি খান পলাশের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সহকারী পরিচালক মো. আল আমীন জানান, তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সম্প্রতি তারা অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছেন। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের তথ্যের পাশাপাশি পৌরসভায় থাকাকালীন তার অনিয়মের বিষয়েও খোঁজ নেওয়া হবে। সাবেক পৌর মেয়র হায়দার গনি খান পলাশের বিরুদ্ধে পৌরসভায় দায়িত্বে থাকাকালীন নানা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। তার ছেলেসহ পরিবারের অনেকেই এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন।
সাবেক সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী: যশোর জেলা যুবলীগের সভাপতি মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থাকাকালীন নানা প্রক্রিয়ায় সরকারি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত কোটি কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন।