অনলাইন ডেস্ক:
৩টা বাজার পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বঙ্গভবনে আসতে শুরু করেন। তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন বাংলাদেশের নবনিযুক্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। ভাষণের সময় বিকেল ৪টা। ৩টা ৫৮ মিনিটে দরবারকক্ষে ঢুকলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। আলোকচিত্র-সাংবাদিকরা আগে থেকেই উপস্থিত দরবারকক্ষে। খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে তাদের ক্যামেরার ফ্লাশ মুহুর্মুহু ঝলসে উঠতে থাকল। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এলেন কিছুক্ষণ পর। তিনি প্রথমে দরবারকক্ষে ঢুকলেন না। ঢুকলেন পাশের একটি কক্ষে। অপেক্ষা করলেন জোটের নেতাদের জন্য। এখানেও ঝলসে উঠল আলোকচিত্র-সাংবাদিকদের ক্যামেরা।
৪টা ১৫ মিনিটে দরবারকক্ষে ঢুকে আসন নেন শেখ হাসিনা। তার জন্য নির্ধারিত স্থান খালেদা জিয়ার পাশে। খালেদা জিয়া তাকে অভ্যর্থনা জানালেন। দুজন কুশল বিনিময় করলেন। দুই নেত্রীকে একই সোফায় পাশাপাশি পেয়ে ছেঁকে ধরেন আলোকচিত্রীরা। তাদের ছবি তোলা আর শেষ হতে চায় না। কে কত ব্যতিক্রমী ছবি তুলতে পারেন তারই প্রতিযোগিতা যেন চলল কিছুক্ষণ। এরই মাঝে দুই নেত্রী নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলতে থাকেন। বঙ্গভবনে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আর এমন দৃশ্য দেখার জন্যই যেন আলোকচিত্র-সাংবাদিকরা প্রত্যাশা নিয়ে বসেছিলেন। ৪টা ২৫ মিনিটে দরবারকক্ষে আসেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন। অত্যন্ত সাদামাটা ও খোলাখুলিভাবে তিনি ১৭ মিনিট কথা বলেন। মাঝে মাঝেই করতালি দিয়ে তার বক্তব্যকে সমর্থন জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও আমন্ত্রিত অতিথিরা। দুই নেত্রী পাশাপাশি বসে এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত প্রত্যক্ষ করেন। ভাষণের পর সবাই চা চক্রে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী দৈনিক ইত্তেফাকের রশীদ তালুকদার, অবজারভারের মোয়াজ্জেম হোসেন বুলু, দৈনিক বাংলার কামরুজ্জামান, রয়টার্সের রফিকুর রহমান, এপির পাভেল রহমান, এএফপির মুফতি মুনীর, সংবাদের লুৎফর রহমান বীনু, নিউ নেশনের একেএম মহসীন, ইনকিলাবের সালাহউদ্দিন, বিটিভির হোমায়েত উদ্দিন আহমেদসহ প্রায় ২০-২২ জন আলোকচিত্র-সাংবাদিক। উপস্থিত ছিলেন প্রায় সমানসংখ্যক প্রতিবেদকও। পরের দিন প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকায় দুই নেত্রীর এই অপূর্ব মিলন দৃশ্যের সাদাকালো ছবি ফলাও করে ছাপা হয়। দুই নেত্রীর এই ছবি সেদিন দেশবাসীকে প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী করে তোলে। এই সুন্দরতম মুহূর্তটি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের হৃদয়ে আইকনিক ছবি হিসেবে জায়গা করে নেয়।
ওই দিন এই ঘটনার ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন ইউসুফ সা’দ। তিনি তখন পাক্ষিক আনন্দপত্র পত্রিকার নিজস্ব আলোকচিত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাস থেকে ফেইসবুক মেসেঞ্জারে তিনি জানান, “ওই দিন দুই নেত্রীই ছিলেন প্রাণবন্ত। তাঁদের চেহারায় ছিল উচ্ছ্বলতা। মুখে ছিল বিজয়ে হাসি। কারও মধ্যে জড়তা ছিল না। সেদিন দুই নেত্রীই পরেছিলেন ঘিয়ে সাদা রঙের শাড়ি। পরিবেশটা এতই আনন্দঘন ছিল যে ওইদিন বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের প্রবেশের ব্যাপারে নিরাপত্তাকর্মীরা ছিলেন আন্তরিক। সাধারণত এই ধরনের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড, নিরাপত্তা পাশ কিংবা রাষ্ট্রীয় ইনভাইটেশনের দরকার হয়। পত্রিকার কার্ড দেখেই আমাকে অনুষ্ঠানে ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল।” ওই দিন তিনি দুই রোল রঙিন ছবি তোলেন। পরে আনন্দপত্রের প্রচ্ছদে দুই নেত্রীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছাপা হয়।
বছর পাঁচেক আগে এক সাক্ষাৎকারে এই আনন্দঘন বিকেলটির কথা আমাকে বলেছিলেন ফটোসাংবাদিক পাভেল রহমান। আমার লেখা আলোকচিত্রালাপ বইয়ে তার বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পাভেল রহমান বলেছিলেন, “সেদিনের বিকেলটা ছিল একেবারেই অন্য রকম। গণ-আন্দোলনের মুখে ওইদিনই স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন হয়। অগ্রভাগে থেকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তখনকার সাত দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া ও আট দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনা। তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে ৮ বছর ২৫৬ দিনের এক দুঃশাসন পর্বের অবসান হয়। ফলে তাদের সম্মানেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এই সভার আয়োজন করেন। দুই নেত্রীর উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে করে মহিমান্বিত আর দেশবাসী ফিরে পায় আস্থা। এই ঘটনার আগেও আরও দুবার তারা একত্রে বৈঠক করেন। প্রথম বৈঠকটি হয় খালেদা জিয়ার বোন খুরশীদ জাহানের গুলশানের বাসায়। দ্বিতীয়টি হয় ১৯৮৭ সালের ২৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার অ্যাটমিক এনার্জির বাড়ির গেস্ট হাউসে।”
এই ঘটনার আরেকজন সাক্ষী সাংবাদিক আহমেদ নূরে আলম। তিনি তখন দৈনিক বাংলার বিশেষ সংবাদদাতা। ওই দিনের ঘটনা স্মরণ করে তিনি জানান, “দুই নেত্রীর মধ্যে পারষ্পরিক প্রীতি ও সৌহার্দ্য সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। তাঁদেরকে দৃশ্যত আনন্দিত ও উল্লসিত দেখাচ্ছিল। আমি দুজনকে আলাদাভাবে প্রশ্ন করেছিলাম—এটা কি শুধুই ফটোসেশন নাকি আন্তরিক ঐক্য চেষ্টা? দুজনের জবাব আমাকে শুধু খুশি নয় প্রচণ্ড আশাবাদীও করেছিল। খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এখানেই শেষ নয়। আমরা ঠিক করেছি ঐক্য প্রয়াস চালিয়ে যাবো। বেগম জিয়া আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার কী মনে হয়? আমি বলেছিলাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি অনন্য ঘটনা যা কার্যকর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পৃথকভাবে করা এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমাদের ঐক্য দেশকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাবে। এই উদ্দেশ্য জনগণ স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছে।” যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই প্রবীন সাংবাদিক দুঃখ করে আমার এক ফেইসবুক স্ট্যাটাসের মন্তব্যের ঘরে লেখেন, “পরবর্তীকালে দুই নেত্রীর এই বৈঠক জাতীয় ঐক্য স্থাপন করেনি।”
বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তরফে জানা যায়, ওইদিন বঙ্গভবনের এই সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি নেতা অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার, সাইফুর রহমান, এম শামসুল ইসলাম, মীর শওকত আলী, মাজেদুল হক, ফরিদা হাসান, জুলমত আলী খান, আর এ গনি, ফরিদা রহমান, অধ্যাপিকা জাহানারা বেগমসহ সাতদলীয় জোটের শামসুল আরেফীন খান, নূরুল হক মেহেদি। আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, মতিয়া চৌধুরী, আইভী রহমান। এসেছিলেন ড. কামাল হোসেন, বেগম জোহরা তাজউদ্দিন, আবদুস সালাম, শেখ আজীজ, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, সাইফ উদ্দিন আহমদ মানিক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, পংকজ ভট্টাচার্য প্রমুখ। পাঁচ দলীয় জোটের রাশেদ খান মেনন, আবুল বাসার, নির্মল সেন, সিদ্দিকুর রহমান, হায়দার আকবর খান রনো, নজরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন মুসলিম লীগের এম এ মতিন, আ ন ম ইউসুফ, জামায়াতে ইসলামের মওলানা আব্বাস আলী খান ও মওলানা মতিউর রহমান নিজামী।
তথ্য সুএঃ বাংলা নিউজ ২৪
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com
Copyright © 2025 RED TIMES. All rights reserved.