আমার বন্ধু সেলিম চৌধুরী

প্রকাশিত: ৪:১৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ৯, ২০২০

আমার বন্ধু সেলিম চৌধুরী

সালেহ মওসুফ

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় সংগীত তারকা সেলিম চৌধুরী আমার বন্ধু । সপ্তাহ খানেক আগে তার সাথে আমার টেক্সট মেসেজে কথা হয় , তখনো বুঝতে পারিনি নিপীড়ক করোনা ভাইরাসে সেলিম সংক্রমিত । তার দুদিন পর সেলিমের একটা ফোন কল আমি ধরতে ধরতে কেটে গেলে আমি আবার ফোন ব্যাক করি কিন্তু সেলিম ফোন ধরেনি। আমার মন কেন যেন খারাপ লাগছিলো এবং ভাবছিলাম সেলিমের কিছু হয়ে গেলো কিনা।
কেন যে এরকম ভাবনা মনে এসেছিলো? দুদিন পর জানতে পারলাম সেলিম চৌধুরী কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমার মন বিষাদে ছেয়ে গেলো। আপন মানুষগুলোকে এই ভাইরাসটি ছাড় দিচ্ছে না।
আমেরিকা , ইংল্যান্ডে সহ বিভিন্ন দেশে পরিচিত জন , বন্ধু, নিকটাত্মীয় অনেকেই সংক্রমিত হয়েছেন। অনেকেই মারা গিয়েছেন । ছোটবেলার বন্ধু যুক্তরাজ্য প্রবাসী শোয়েব (সালেহ) কোভিড ১৯ এ আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যু বরণ করে। মৌলভীবাজারে আমাদের গির্জা পাড়ার আমার এক প্রিয় আপু পপি আপু এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম । অনেকদিন ভোগার পর আপু ভালো হয়েছিলেন।
দুঃখের বিষয় হলো কেউই করোনা মহামারীতে আপনজনকে কাছে পায় না। এই ঘটনাগুলোর রেশ কাটতে না কাটতেই বন্ধু সেলিম চৌধুরী আক্রান্ত হলো।

সেলিম চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮১ সালে যখন আমরা এক সাথে সিলেটের এমসি কলেজে ভর্তি হই। সেলিম একজন মেধাবী ছাত্র । আমার বন্ধুটি একজন বিনয়ী সদা হাসিখুশি আমোদে মানুষ । সেলিমের পরিবারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। খুব সম্ভবত ১৯৮২ সালে প্রয়াত তাহেরা আপার বিয়েতে আমরা বন্ধুরা মিলে বিয়ের দুদিন আগে শমসেরনগর পোছাই। অনেক মজা করি। তাহেরা আপা আমাকে অনেক আদর
করতেন। মনে পড়ে বিয়ে শেষ হলে বরযাত্রীদের বাসে উঠে মৌলভীবাজার ফেরত এসেছিলাম। আমার সাথে আমার বন্ধু ( খালাতো ভাই) ইকবাল ছিলো। ভাঙ্গা রাস্তায় বাসটি দুলছিলো। ভয়ঙ্কর জার্নি । সেকথা মনে হলে আজো আঁতকে উঠি।
তাহেরা আপার বিয়ে হয়ে ছিলো মরমী সাধক হাসন রাজার পরিবারে মমিনুল মউজদীন ভাইয়ের সাথে। যিনি সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। যদ্দূর মনে পড়ে ১৯৮৩ সালে সুনামগঞ্জে তাহেরা আপা ও মউজদীন ভাইয়ের অতিথি হয়ে গিয়েছিলাম মরমী সাধক হাসন রাজার বাড়িতে। বেশ কটি গান গেয়েছিলাম । যে হারমোনিয়ামটি বাজিয়েছিলাম তা ছিলো অনেক লম্বা এবং খুব সুন্দর । ইতিপূর্বে এরকমটি কোথাও দেখিনি।


সেলিম এবং আমি এমসি কলেজের হোস্টেলে থাকতাম। সেলিম সেকেন্ড এবং আমি থার্ড ব্লকে থাকতাম । আমাদের ঘনিষ্টদের মধ্যে আরো অনেক মেধাবী বন্ধুরা ছিলো। তাদের মধ্যে সাঈদ, শামীম, রবিন, ইকবাল, শাহজাহান, বশির আকবর, শাকেরের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। আরো অনেকেই ছিলো কিন্তু সকলের নাম মাথায় আসছেনা।
এক রাতে জাফলং পিকনিকে যাবার (পরের দিন সকালে) আগে গানের অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। আমি আমার কক্ষে বসে পড়ছিলাম । হঠাৎ মাইকে কে একজন খুব সুন্দর কন্ঠে কিশোর কুমারের ” কি আশায় বাঁধি খেলাঘর ” গানটি গাচ্ছিলো। আমি সাথে সাথে কক্ষ থেকে বেড়িয়ে খুঁজতে লাগলাম কে সেই শিল্পীটি। পরে জানলাম এতো আমাদেরই সেলিম । আজকের জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পী সেলিম চৌধুরী ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে সেলিম চৌধুরীর সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বজায় ছিলো। সেলিম এবং মাসুম ( বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী পদার্থবিদ) শহীদুল্লাহ হলের এনেক্স বিল্ডিং এ থাকতো। মাসুদের সাথে আমার অনেক হৃদ্যতা ছিলো। আমি তখন মহসীন হলে থাকতাম। সেলিম এবং মাসূম দুজনই আমাকে অনেক ভালোবাসতো। ইকবাল আবদুল্লাহ হারুণও ( বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের জাতিসংঘ প্রতিনিধি ) ছিলো শহীদুল্লাহ হলে। ওরা সবাই মিলে আমাকে বললো “আমরা রুমের ব্যবস্থা করছি তুমি শহীদুল্লাহ হলে আমাদের কাছে থাকবে।”
আমার জন্যে শহীদুল্লাহ হলের মূলভবনে একটি রুম ঠিক করা হলো । সাথে নারায়ণগঞ্জের ওয়ালী আর সাতক্ষীরার পিন্টু । কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ তখন হাউস টিউটর ছিলেন । আমি শহীদুল্লাহ হলে বহিরাগত । একদিন হুমায়ূন স্যার হল পরিদর্শন করতে আসলে আমি এমোনিয়া সমৃদ্ধ বাথরুমে গিয়ে নাক চেপে তিরিশ মিনিট কাটিয়েছিলাম।


তখন ১৯৮৮ সাল।
একদিন সেলিম আমাকে বললো সে কিছু গান রেকর্ডিং করছে। তখন গানের ক্যাসেট বের হতো। সেলিম যদিও খুব একটা আলোচনা করতো না গানের বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু আমি জানতাম। এর কিছুদিন পর সেলিম চৌধুরীর প্রথম এলবাম “কবিতার মতো চোখ” বাজারে আসে। তার এলবামটি হিট হয়েছিলো। কয়েকটি গান খুব ভালো লেগেছিলো আমার কাছে যেমন “কবিতার মতো চোখ যে তোমার”, “তুমি শ্রাবণের নিশি হয়ে, “কারে দেখানো মনের দুঃখ”, “দিন চলে যায় বেহালার সুর শুনে”, । আমার কাছে সেলিমের কন্ঠে আধুনিক ধাঁচের গানগুলো ভালো লাগে। তার কন্ঠের মেলোডি দারণ।

“কবিতার মতো চোখ” এর পর সেলিমকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। হুমায়ূন আহমদের সাথে সেলিমের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো এবং ওনার সাথে সেলিম অনেক কাজ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় গান “আইজ পাশা খেলবোরে রে শ্যাম ” । এই গানটি এক সময় অলিখিত জাতীয় সংগীতে পরিণত হয়েছিলো। হুমায়ূন আহমদ সেলিম চৌধুরীকে অনেক ভালোবাসতেন। যদ্দূর জানি একটি বই উনি সেলিমকে আমার আরেক বন্ধু ফজলুল তুহিনের সাথে যৌথনামে উৎসর্গ করেছিলেন। সেলিম চৌধুরী একজন গায়ক হিসেবে অনেক জনপ্রিয় এবং বাংলাদেশে একটি household নাম।
সেলিম চৌধুরীর আরেকটি দিক না বললেই নয়। সেলিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র ছিলো। সে মাইক্রোবায়োলজিতে তে মাস্টার্স পরীক্ষায় ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিলো। সেলিম মৃদুভাষী। বিভিন্ন বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখে। বন্ধু হিসেবে সেলিম অতুলনীয় । সেলিম চৌধুরীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি । সেগুলো না হয় আগামীতে লিখবো।
আজ শুধু সবাইকে অনুরোধ জানাবো প্রিয় শিল্পী সেলিম চৌধুরীর আশু রোগমুক্তির জন্য আপনারা বেশী করে প্রার্থনা করবেন।।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930