একটা হাত অন্তত আসুক ওদের জন্য

প্রকাশিত: ১২:২৭ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০১৮

একটা হাত অন্তত আসুক ওদের জন্য

লুনা হাসান

লাল শাড়ী পড়া… এলো খোপা বাঁধা… দুধে আলতা গায়ের রং মেয়েটার। ফি বছর বাবার বাড়ী আসে স্বামীর সাথে। কিছু দিন থাকেন আবার চলে যায়।
কে এই মেয়েটা?? পরিচয় করায়ে দেই।
সে আমার চাচাত বোন। নাম শিরিন। পুরো নাম আমিও জানি না।

শিরিন যেভাবে ঘোমটার বউ টি হল…..

বেতাগী থেকে আঃ গফুর সাহেব এলেন বর সেজে। ছেলের জমি – জিরাত আছে ভালই। নিজের ব্যবসা আছে।মুসুল্লী আছেন। দেখতে শুনতেও ভালো। সে তাকে বউ করার ইচ্ছা জানাল। এই মেয়েটা আবার ছোট চাচার খুব ভক্ত ছিল। তাই চাচাই তাকে জৌলুশ করে বিয়ে দিল। সব খরচ পাতি দিয়া। এটা তার আনন্দ।
মেয়েটা ভালোই আছে। ধানে পানে ভর্তি।
মাশা আল্লাহ। শিরিন খুব মজার মানুষ। খালি হাসে। সাজতে ভালোবাসে। কাজল তার প্রিয়। আর প্রিয় চকলেট। দুলাভাই সব সময় এনে রাখত।

শিরিন যখন ভুলে গেল হাসি….

শিরিন আপা যখন আসেন… এই কথাটা বাতাসে ভাসতেই থাকে। ওর কোল কি আল্লাহ ভরে দিবেন না?? এরপর ই কথা আসে… তার যা ইচ্ছে। শিরিনার মুখে এখন হাসি নাই। চুপ চাপ থাকতেই ভালোবাসেন। তার বিয়ের কথা আমার মনে নাই। তাই প্রথম দিকের কথা বলতে পারব না।

একদিন দুলাভাই এলো সুখবরের ঝুড়ি নিয়ে। শিরিন মা হতে যাচ্ছে। বিয়ের ২০ বছর পর। কি আনন্দ সে দিন। ভালোই যাচ্ছিল দিন। কালে ভদ্রে চিঠি আসে। একদিন খবর এল… শিরিন ছেলের মা।

সাখাওয়াতের মা এল বাবার বাড়ী….

সেবার আর একটা ব্যাগ নিয়ে নয়… বেশ কিছু ব্যাগ নিয়ে বেড়াতে এল শিরিন। এবার আর দুলাভাই বউকে রেখে বাড়ী যান না।তার যেন বাড়ী কোন কাজই নাই। সারা দিন দুইজনে সন্তানের সেবায় কাটায়। আর কারো সাথে যেন তাদের কথাই নাই। তারা তারাই কথা বলে। তিনজনে এক সাথে ঘুমায়। সাখাওয়াত তখন ৭/৮ মাসের হবে।
কারো কোলে নেবার ও জো নাই।
যাই হোক জীবনের সেরা সময় কাটায়ে শিরিন দম্পতি আবার ফিরে গেল নিজ ঘরে।

শিরিন ২য় বার মা হতে যাচ্ছে…..

দুলাভাই সুখবর নিয়ে আসেন… শিরিন মা হতে যাচ্ছে। তবে সে খুব অসুস্থ। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার মনে নাই তখন
চাচি বেঁচে ছিলেন কিনা??
এবার ও সে ছেলের মা হল। ছেলের নাম…
সুমন। মায়ের মতই ছেলেরা সুন্দর। যেমন গায়ের রঙ… তেমন সুন্দর তাদের দেহের গঠন। মাশা আল্লাহ।

শিরিন যখন চিন্তিত……

সুমনের বয়স বছর খানি হবে তখন সে এল। কিন্তু এবার আর শিরিন খলখল করে হাসে না। বড় ছেলে একটু অন্য রকম। বাড়ি এসে বোরকা খুলেই আমার মায়ের কাছে ওকে নিয়া এল। ছেলে কানেও কম শুনে.. কথা খুব বেশী বলে…এক কথা অনেক বার বলে। আর বুদ্ধি কম।

এখন একটু অন্য কথা বলি….

শিরিনের ও বুদ্ধি খুব কম। একেবারেই কম।
দুলাভাই ও সহজ সরল মানুষ। অত আগে তো অটিজম নিয়ে এত কথা হত না। ধরে নেয়া হয়েছে.. ছেলে সহজ সরল হবে।
তাতে কি??? ছেলে মা – বাবা ডাকে… চুমু দেয়….কোলে চড়ে। এরচে আর কি চাই??
দুই ছেলে নিয়ে তাদের আর ফুরসৎ নাই। সারাদিন সাখাওয়াত..সুমন। শিরিন… গফুর দম্পতি সব চেয়ে সুখী দম্পতি। এখন আর দুলাভাই বউ বাচ্চা রেখে বাড়ী যান না।আর আগে তার পরের দিন ই চলে যেত। শিরিন অনেক দিন থাকত। বাড়ী তার ক্ষতি হয়। তাও সে বউয়ের উপর ওদের রেখে যান না।

শিরিন এবার ভেংগে পরে…..

সাখাওয়াত মৃগী রোগী। যখন তখন জ্ঞান হারায়। পুকুরে পরে যায়। চলা ফেরায় সে অস্থির। কোথাও বসে না। ওকে সামলাতেই শিরিনের দিন কেটে যায়।এরপর ও শিরিনের দুঃখের ভার কম… ওযে তাকে মা ডাকে।

শিরিন যখন এক সাগরের সামনে দাঁড়ায়ে….

মেজ ছেলে সুমন ও বড় ভাইয়ের মত বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তবে ও মৃগী রোগী না। ও বড় ভাইয়ের মত চঞ্চল না। একা থাকতে ভালোবাসে। পাইলে খায়… না পাইলে অভিযোগ নাই। ওকে নিয়ে মায়ের দৌড় ঝাপ কম।

৩য় ছেলের মা শিরিন…..

এই ছেলের নাম রাখা হয় হাসান।
আলহামদুলিল্লাহ্‌। সে সব দিক হতে সুস্থ। পড়া শুনায় ও ভাল।ছেলেটা ভদ্র। এক কথায় সোনার ছেলে। শিরিনের মুখে হাসি ধরে না।

শুরু হল শিরিনের যুদ্ধ….

আমি ও শ্বশুরকুলে আসি…শিরিনের সাথে আর দেখা হয় নাই।
এর ভিতরে অনেক কিছু হয়ে যায়। দুলাভাই মানসিক রোগী হয়ে যান। এই দুনিয়ার কোন হুশ তার ছিল না। অনেক বছর তিনি এভাবে ছিলেন। ব্যবসা বন্দ হয়ে যায়। এই সুযোগে তাকে ঠকানো শুরু করল সবাই। সংসারে নেমে এলো কস্টের পাহাড়। ৩ জন রোগী নিয়ে শিরিন সাগরে। শিরিনের মা খুব ভাল মানুষ ছিলেন। বাবা – মা কেউ বেঁচে নেই। যুদ্ধ টা তার একার।

যেভাবে দেখা হল তার সাথে….

২ বছর আগে শিরিনের ভাইর বউ মারা গেলেন… তখন দেখা হল তার সাথে। সে আর লাল শাড়ী পরে না। নেই সে গায়ের রঙ। হাসি ভুলে গেছে। অনেক কথা হইছিল তার সাথে।

এবার বলি হাসানের কথা….

হাসান বি এম কলেজ দিয়া বাংলায় অনার্স করে মাস্টার্স করে। ওর মা তাও জানে না কি পড়ে? বলে বি এ পড়ে। সে খুব হাসে হাসানের কথা উঠলেই। আমাকে বলে..
লুনা হাসান যখন বড় চাকরী করবে তখন সব জায়গায় বেড়াতে যাব।খালি হাতে কি ভাবে যাই?? সব চেয়ে বড় কথা হল…. হাসান খুব ভদ্র। সে নিজের পড়ার খরচ নিজে জোগাড় করে… বাড়ী চালায়।

একটা খবর সব কিছু মুছে দিল….

৭/৮ মাস আগে আমার মা ফোন করে বলে… শিরিনের ছেলে হাসান খুব অসুস্থ। ওর কিডনি সমস্যা। ও ভাল নেই।।বরিশাল মেডিকেলে ভর্তি আছে। শুনে প্রথম আমার যেটা মনে আসল… কি ভাবে আসবে ওর চিকিৎসার টাকা?? ১ দিন পর শুনি ওর কিডনিতে ক্যান্সার হইছে। আমার খুব অস্থির লাগতে ছিল। কি করি?কিছুই জানি না।কারো কাছে সাহায্য চাইব সে রকম কোন কাগজ পত্র ও নেই।

আমাদের বরিশালের বেশ বড় ফেসবুক গ্রুপ আছে। আমি ওখানের এডমিন হিসাবে আছি। ওই দিন সারা দিন গ্রুপে থাকলাম… ওর কোন বন্ধু যদি সাহায্য চেয়ে পোষ্ট দেয়। রাত ১ টার দিকে একটা পোষ্ট আসল। আমিও বলে রাখছি… হাসান নামে সাহায্যের জন্য কেউ পোষ্ট দিলে যেন আমাকে জানায়। সাথে সাথে ওই ফোন নাম্বারে ফোন দিয়ে পরিচয় দিলাম।অন্য এডমিনদের উঠালাম। কথা বলে সব ঘুছাতে প্রায় ফজর। সিদ্বান্ত হল… ওই দিন ৬টা স্কুল.. কলেজে টাকা তোলা হবে। টিম রেডি হল। কে কোথায় যাবে??
কি ভাবে টাকা পাঠান হবে?? সব কিছু রেডি।সকাল হলেই হয়।

ওরা জানালো হাসান এখন ঢাকা। ওর মামার কাছে। বরিশাল থাকতে ওরাই ওর দেখা শুনা করছে। মা শুধু কাছে থাকতো।
আমার মাথায় এল আমার বড় ভাই আছেন….
Dr.Habibullah Talukder Ruskin.
Associte Professor at Ministry of Health and Family Welfare.
Head of cancer Epidemiology at National Insitute of cancer Research.
ভাইয়াকে বলে রাখলাম। সকালে ভাইয়া দেখেই… বললেন ১০ টার পর এসে যেন তোমার কথা বলে। আর কিছু লাগবে না। যা যা লাগে করা যাবে। ভাইয়া এই কথা টা সব সময় বলেন… কেউ কে যদি বাঁচানোর আশা কম থাকে….তার জন্য এটা করা যায়… যাতে সে কষ্ট কম পান। আমি আর একটু চিন্তা মুক্ত হলাম… ভাইয়ার কাছে থাকলে টাকা কম লাগবে।

খুব সকালে আমার মা ফোন দিল। আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে গেলাম.. কি কি করতে পারব। সে কিছুই বলে না। কিছুক্ষন পর বলে… ওর আর টাকা লাগবে না। তুমি চিন্তা কইরো না। আমি…. কে দিল টাকা ওকে??
মা…. লাগবে না। ও রাতেই চলে গেছে। ওখানে ডাঃ ওকে ভর্তি ই করেন নাই। বলেছিল… বাড়ী নিয়া যান। আল্লাহ চাইলে ও ভালো হয়ে যাবে। আজই যাবেন পারলে।
যেদিন এলো বাড়ী তার পরের দিন রাতে ৩ টার দিকে ও পাড়ি জমাল অন্য জগতের জন্য।

আলহামদুলিল্লাহ্‌। ইন্না লিল্লাহে…রাজিউন।

আমি যখন টিম করতেছি….. ও তখন ওপাড়ে যাবার জন্য প্রস্তত হচ্ছে। আমার শরীরের সব রগ একবার টান দিলো।এটাই মনে হয় রক্তের টান। ওদের খবর দিলাম।এরাই প্রকৃত বন্ধু। যারা পালা করে রাত দিন ওর কাছে ছিল। নিজেরা চাঁদা তুলে খরচ চালিয়েছে। ওরা খুব প্রশংসা করল হাসানের।

মা বলল… ওরে এখন গোসল করায়। সবাই যে যেমন পারছে ওকে সাজিয়ে দিল। কোন অসুবিধা হয় নাই। ওরা আমাকে অনুরোধ করে ছিল যাতে শিরিনকে আমার মায়ের কাছে রাখি। খুব ভালো প্রস্তাব। কিন্তু সাখাওয়াত আর সুমনের দায়িত্ব কে নিবে?? তারা যে শিশু। আল্লাহ্‌তায়ালা শিরিন কেই যোগ্য মনে করেছেন… তাই তার ঘরে ওদের পাঠিয়েছেন। ওদের সাথে কথা হল বিভিন্ন রকম। আমি সালাম জানাই এই বন্ধু দের। শিরিন ও ভাত খায়… খাবে…বেঁচে থাকবে… যতদিন আল্লাহতালা না নেন।

যে ভাবে রিজিক আসে…..

বড় ছেলে গেল শীতে একটা লাউ গাছ লাগায়ে ছিল। সেই গাছ হতে ২২ হাজার টাকার শুধু শাক ই বিক্রি করছে। তাতে গাছের কিছু হয় নাই। সে পূর্ণ রুপেই আছে। এর পর আর আমি জানি না..
এ ভাবেই কোন না কোন ভাবে রিজিক চলে আসবে। বেঁচে থাকবে এই পরিবার।
দোয়া করবেন… শিরিন… সাখাওয়াত… সুমনের জন্য।
এই পৃথিবীতে কোন হাত আসুক ওদের ছায়া হয়ে। কেউ ভাবুক ওদের নিয়া। কেউ এসে বলুক… তোমার খিদে লাগছে… ভাত খাবে চল।