বর্ষবরণ এক প্রাণোচ্ছল উৎসবের নাম

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০১৮

বর্ষবরণ এক প্রাণোচ্ছল উৎসবের নাম

সৌমিত্র দেব
বাংলাদেশে বর্ষবরণ এক প্রাণোচ্ছল উৎসবের নাম ।এ দেশের প্রতিটি জাতি- উপজাতি ,বৃহৎ বা ক্ষুদ্র সকলের জীবনেই বর্ষবরণ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।বিশাখা নক্ষত্র থেকে এসেছে বৈশাখী । বাঙালিদের বৈশাখীর প্রায় কাছাকাছি নাম মণিপুরীদের বিষু ,ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’, চাকমাদের ‘বিজু’ এবং বাংলার প্রতিবেশী ভারতের অসম রাজ্যে অসমিয়াদের বিহু উৎসব ।
.নতুন বছরকে আনন্দ-উৎসবে বরণ করে নেওয়ার রেওয়াজ আজকের নয় । সেই প্রাচীনকাল থেকেই এটা পালিত হয়ে আসছে । গবেষকেরা বলছেন, এই রীতি প্রায় চার হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন ব্যাবিলনে মার্চ মাসে দিনরাত সমান, এমন দিনটির পর প্রথম পূর্ণচন্দ্র দৃশ্যমান হওয়ার দিনকে নতুন বছরের শুরু হিসেবে ধরা হতো। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ১১ দিন ধরে উৎসব চলত। যার নাম ছিল আকিতু।
সময়ের সঙ্গে সভ্যতাভেদে বর্ষবরণের দিনক্ষণে পরিবর্তন হয়েছে। চীনে ঘটা করে নববর্ষ পালনের প্রমাণ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে। চীনের মানুষ এ সময় তাদের প্রায় সব কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিত। প্রতিটি বাড়ি খুব ভালো করে পরিষ্কার করা হয়, যেন ঘরে কোনো ‘হুইকি’ অর্থাৎ অশুভ বায়ুর উপস্থিতি না থাকে। বছরের প্রথম দিনে প্রতিটি পরিবার নিকটাত্মীয় নিয়ে একসঙ্গে খাবার খান। বছরের দ্বিতীয় দিনে পুরো পরিবার একটি পূর্ণ চন্দ্রাকৃতির পুডিং ভাগাভাগি করে খায়। এটাকে মনে করা হতো পরিবারের ঐক্যকে সমুন্নত রাখার প্রচেষ্টা। এ ছাড়া বর্ষবরণের অংশ হিসেবে বের করা হতো শোভাযাত্রাও।
জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে নতুন বছর শুরুর প্রচলন করেন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার। রোমানরা বছরের প্রথম দিনটি উদ্যাপন করত দেবতা জানুসের প্রতি মূল্যবান সামগ্রী উৎসর্গ, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সঙ্গে উপহার বিনিময়, বড় ভোজসভা আয়োজন করে। এখন তো দুনিয়াজোড়া রঙিন আয়োজনে বরণ করা হয় ইংরেজি নতুন বছর।
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, কৃষিকাজের সুবিধার জন্যই মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে (৫ নভেম্বর ১৫৫৬)। নববর্ষে ভূস্বামীরা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা, আলপনা আঁকাসহ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পয়লা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে এর সঙ্গে অর্থনীতির ব্যাপারটিও জড়িত ।
পহেলা বৈশাখ যেমন বাঙালির প্রাণের উৎসব তেমনি এদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসরত ১৩টি আদিবাসী সম্প্রদায়েরও প্রাণের উৎসব।
বৈসাবি’ মানেই যেন জলকেলি, ফুল ভাসানো, পাহাড়ি মেয়েদের নৃত্য, আদিবাসীদের আদিম উৎসব! অন্তত বাংলাদেশের মানুষের কাছে মিডিয়ার উপস্থাপনা তাই বলে। নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার রীতিকে ত্রিপুরারা বলে ‘বৈসু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ আর চাকমারা ‘বিজু’। এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবকে একত্রে বোঝাতে ‘বৈসাবি’ নামক শব্দের কম্পোজিশন তো মিডিয়ার অপূর্ব সৃষ্টি! অথচ পার্বত্য এলাকায় গিয়ে এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাউকে জিজ্ঞেস করলে তারা কখনোই ‘বৈসাবি’ উৎসবের নাম বলবে না। তারা বলবে বিজু, বৈসু/ বৈসুক, চাংক্রাই, সাংগ্রাই কিংবা শাংরাই। ‘বৈসাবি’ নামক ‘খিচুড়ি’ মার্কা নাম দিয়ে শুধুমাত্র তিনটি সম্প্রদায়ের উৎসবের কথাই লেখা হয়, কিন্তু বাকি ১০টি আদিবাসী সম্প্রদায় কি নতুন বছরকে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে বরণ করে না? অবশ্যই করে এবং তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমরা ভালোভাবে জানি না বলেই জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার চরম উৎকর্ষটা এখানে প্রকাশিত হয়ে আদিবাসীদের সংখ্যাতত্ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখানো হচ্ছে।

তাছাড়া, শহরের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান যোগাযোগ, শিক্ষার ক্রম-প্রসার, পেশাজীবী শ্রেণির বিকাশ, স্বচ্ছল অর্থনৈতিক-অবস্থা, আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা, প্রচলিত উন্নয়ন-ডিসকোর্সের কাঠামোয় নিজেদের অবস্থান এবং নিজের কথা নিজের মতো করে বলবার ক্ষমতা কিংবা অক্ষমতার মাপকাঠিতে চাকমা, মারমা এবং ত্রিপুরার তুলনায় পিছিয়ে আছে অন্য পাহাড়ি আদিবাসীরা।

যেকোনো দেশের কিংবা সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ অবশ্যই তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের অংশ। পাহাড়ি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বর্ষবরণের রীতি-রেওয়াজ তাই সর্ম্পূণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে উঠে। পাহাড়ি জীবন মূলত ঋতুকেন্দ্রিক, তাই ঋতুর আগমন এবং বিদায় এ মানুষদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো বছরের বিদায় এবং নতুন বছরের আগমন এবং সে বিদায়-বরণ কেন্দ্র করে নানা ধরনের রীতি-নীতি পাহাড়ি জীবন-ব্যবস্থার অংশ। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ জীবন-ভাবনা, আনন্দ, নতুনকে বরণের আন্তরিক আয়োজন ও উৎসব।বাঙালি -অবাঙালি, পাহাড়ি- সমতল বাংলাদেশের সব মানুষের জীবনেই বর্ষবরণ তাই অর্থবহ ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930