বাংলা একাডেমির বানান রীতি ও একটি সাম্প্রদায়িক বয়ান

প্রকাশিত: ৪:৩৫ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৭, ২০২৪

বাংলা একাডেমির বানান রীতি ও একটি সাম্প্রদায়িক বয়ান

 

সৌমিত্র দেব

আহমদ ময়েজ একজন বিলেত প্রবাসী কবি ও চিন্তক । তিনি লন্ডনের সুরমা পত্রিকায় কর্মরত । মূলত ছড়া লেখক হলেও একসময় বাউল সঙ্গ করেছেন বলে দাবি করেন । কিন্তু তার গদ্য রচনার মধ্যে সব সময় ই কিছু ছদ্মসাম্প্রদায়িকতার চিহ্ন পাওয়া যায় । সম্প্রতি তিনি তার এক রচনায় বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে , আমাদের গোটা ভাষানীতির বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ এনেছেন। সেই অভিযোগের মধ্যেই আছে সাম্প্রদায়িক বয়ান ।
‘দ্রাবিড়’ নামের একটি ওয়েব জিন। সেখানে ময়েজ সাহেব লিখেছেন ,’বাংলা একাডেমির ভাষার রাজনীতি : যবন ঘৃণার মাধ্যমে শুদ্ধিকরণ ‘ শিরোনামের একটি জটিল লেখা । কিন্তু একটু পরেই বুঝলাম , যাকে আমি জটিল ভেবেছি তা আসলে জলবৎ তরলং । এটা কোন পাণ্ডিত্যপূর্ণ রচনা নয় । এর লাইনে লাইনে ছড়িয়ে আছে ভুল তথ্য ,গালাগালি আর সাম্প্রদায়িকতার দুর্গন্ধ । কবি কেন এ রকম একটি কুরুচিপূর্ণ রচনা লিখলেন, আমার ঠিক বোধগম্য হলো না। এটা কি বাংলা একাডেমিকে গালাগালি করে স্রেফ দৃষ্টি আকর্ষণ ?
তিনি লেখাটির শুরুতেই এনেছেন ভুল তথ্য ।
” অন্ত্যজনেরা কি পাপ করেছিলেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে? এ প্রশ্ন আজ হাড় ও জিগড় কেটে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে । হাজার বছরের ক্ষোভ ও ঘৃণা যেন ফেটে পড়তে চায় ।

এ বঙ্গভূমি যখন অরক্ষিত তখন একদল মানুষ এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ।
বড়দাগে এই নিগৃহীত মানুষ ই ছিলেন নমঃ শুদ্র বা অন্ত্যজন । তাদের না ছিল ভাষার মূল্য আর না ছিল মানুষ মূল্য । তারা একদল সুফী চিন্তকের সংস্পর্শে এসে বদলে গেল । সাহসী হয়ে ওঠলো । প্রত্যাখ্যান করলো পিতা পিতামহের ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি – যে ধর্মের শ্রেণীবর্ণ গোষ্টি তাকে ক্ষুদ্র ও ঘৃণার বস্তু করে রেখেছিল … । ”
,প্রথম প্যারাতেই একটি ধর্ম ও সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেখকের ক্ষোভ ও ঘৃণা যেন ফেটে পড়তে চায় । বাংলা একাডেমির ভাষা রাজনীতি বাদ দিয়ে লেখক শুরুই করলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে । তাতে কোন অসুবিধ নেই । অসুবিধা হলো মিথ্যাচারে । তিনি প্রথম লাইন শুরু করলেন সেই মিথ্যা দিয়ে , যে বয়ান্ তৈরী করেছেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা । তারা বলেছেন , অন্ত্যজন, ডোম, চাঁড়াল , নমশূদ্ররা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। সরল এই বয়ান খুব তরল ভাবে ব্যবহার করেছেন লেখক । কিন্তু বাস্তবে এর সত্যতা কোথায় ? এখনো বাংলাদেশে অন্ত্যজন বলতে যাদের বোঝায় , সেই মুচি, মেথর , ডোম , চাঁড়াল , নমশুদ্রদের প্রায় সবাই হিন্দু ধরমালম্বী। তাই বলে সুফী প্রভাবে অন্ত্যজনেরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি, সেকথা বলছি না । কেউ কেউ সে ভাবে মুসলমান হয়েছেন । কিন্তু সবাই নন । হিন্দু সেন রাজারা বৌদ্ধ পাল রাজাদের হাত থেকে ক্ষমতা নিয়েছিল । বাংলায় মোট জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ছিল বৌদ্ধ । তারাই মূলত ইসলাম গ্রহণ করেছেন। যে কারণে বাংলাদেশে এখন বৌদ্ধ জনসংখ্যা খুব কম । তাছাড়া দীর্ঘ প্রায় ৭০০ বছর বাংলাদেশকে শাসন করেছে তুর্কী , আফগান , পাঠান , মোগল ও পারস্য থেকে আসা মুসলমান শাসকেরা । তাদের বংশধরেরা এই দেশে থেকে বাঙালি মুসলমান হয়েছে । ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের সময় বহু উচ্চ বর্ণের হিন্দু খ্রিস্টান হয়েছেন । রাজকীয় আনুকুল্য পাবার জন্য মুসলিম শাসনামলেও হিন্দুদের বড় একটা অংশ নিশ্চয় ই মুসলমান হয়েছেন । লেখক আহমদ ময়েজ এর দেশের বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায় । আমি সেখানকার ৩ জন কৃতি সন্তানের নাম বলছি । হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী , দেওয়ান মোহামদ আজরফ ও হাছন রাজা । তারা ৩ জনেই অভিজাত হিন্দু পরিবারের উত্তরাধিকারী পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করতেন। হিন্দু আত্মীয়দের সংগে এখনো তাদের পারিবারিক সম্পর্ক আছে । কাজেই অন্ত্যজনের ক্ষোভ ও ঘৃণার যে গল্প তিনি শুরুতেই শুনিয়েছেন , তার কোন ভিত্তি নেই ।
দ্বিতীয়ত লেখক বলেছেন, ‘এ বঙ্গভূমি যখন অরক্ষিত তখন একদল মানুষ এসে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ।’ আমার প্রশ্ন হলো , এই যখনটা কখন ? এর কি নির্দিষ্ট কোন সময় নেই? তিনি ইচ্ছে মতো বঙ্গভূমিকে অরক্ষিত করে দিতে পারেন তাঁর দায়িত্বহীন কবিতায়। কিন্তু বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবেন যে রচনায় তাকে তো খাম খেয়ালি হলে চলবে না ।
এরপরে লেখক আহমদ ময়েজ তাঁর গালাগালি অব্যহত রেখেছেন অপ্রাসঙ্গিক ভাবে এ দেশের প্রগতিশীল সমাজ ও দিল্লীর শাসকের বিরুদ্ধে । তাঁর গালি থেকে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাও বাদ যায় না । এ সবের উদ্ধৃতি দিতে গেলে পাঠকের ধৈর্য চ্যুতি ঘটবে , তাই সে পথে গেলাম না । অবশেষে তিনি আসল প্রসঙ্গে এলেন। তিনি দাবি করলেন, ” বাংলা ভাষাকে ধর্মীয় ব্যাকরণ দ্বারা সাম্প্রদায়িক বানানরীতি প্রবর্তন করা হয়েছে । এটা করেছে বাংলা একাডেমি । কোলকাতার সাম্প্রদায়িক বানান রীতি অনুসরণ করতে গিয়ে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে বাংলা একাডেমি । ” আমার মনে হয়, আর উদাহরণ প্রয়োজন নেই । আমি নানা রকম ব্যাকরণের কথা শুনেছি। ধর্মীয় ব্যাকরণের নাম শুনি নি । কোলকাতার সাম্প্রদায়িক বানান রীতিও যে একটা কিছু আছে সেই জ্ঞান পেলাম এই লেখা থেকে । ্তিনি মূলত ভারত , হিন্দু ও সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলাকে মুক্ত করতে চান । তিনি বলেছেন , সংস্কৃত যুগ নিম্ন বর্ণের মানুষকে ‘ যবন ‘ ভাবে । এরপরে তিনি হুঁশিয়ার করেছেন , ” পৌত্তলিক ধর্মের নীতি দিয়ে যদি বাংলা ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় তাহলে সে ভাষা আর জনগণের ভাষা বলে গণ্য হবে না । ”
লেখকের এই রচনা বাংলা একাডেমির কি ছিঁড়তে পেরেছে আমি জানি না । কিন্তু তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা দেখে আমি মুগ্ধ । এই লেখা পাঠ করে আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ এখনো দিল্লীর উপনিবেশ । এ দেশ চালাচ্ছে পৌত্তলিকেরা । কোলকাতা থেকে আমাদের বানান রীতি নিয়ন্ত্রণ হয় । আর এ সব বোঝার মতো জ্ঞান একমাত্র আহমদ ময়েজ সাহেবেরি আছে ।শুধু সাম্প্রদায়িকতার পুকুরে ডুব সাঁতার দেবার পর এরকম অসাম্প্রদায়িক চিন্তক পাওয়া সম্ভব।

ভারত আর পাকিস্তান যেমন একই দেশ ছিল,হিন্দি আর উর্দু তেমনি একই ভাষা ছিল।ভারতে মুসলমান আছে।পাকিস্তানে ও হিন্দু আছে। একইভাবে হিন্দি উর্দু দুই নামে একই ভাষায় দুই সম্প্রদায়ের লোক কথা বলে। এখন আমাদের দেশে কিছু পন্ডিত গজিয়েছেন। তারা পশ্চিম বংগের বাংলা ভাষা থেকে আমাদের বাংলা ভাষাকে আলাদা করতে চান। সেটা করতে না পেরে বাংলাদেশের সরকার ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান কে গালাগালি করেন। হয় তো আমাদের বাংলা ভাষাকে তারা নতুন কোন নাম দেবার প্রস্তাব করবেন আগামীতে। ১৯৭১ সালের আগে হলে এর নাম হতো পাকিস্তানী বাংলা। এখন বাংলাদেশ যখন হয়েই গেছে,এর নাম হতে পারে বাংলাদেশি বাংলা। বাংলা ভাষাকে খতনা করা যেতে পারে। পাকিস্তান আমলে সে কাজ কিছুটা এগিয়ে ছিল। সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি- এই লাইন কে পড়তে হবে – ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি।

সৌমিত্র দেব ঃ কবি