যুদ্ধ

প্রকাশিত: ১২:০৪ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০১৮

যুদ্ধ

 

তারিক সামিন

 

[পটভূমি : ২০১৬ সাল। তখন বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ চলছে। প্রতিদিন যুদ্ধে আহত-নিহত হচ্ছে অজস্র নিরপরাধ মানুষ। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান জুড়ে চলছে ইঙ্গ-মার্কিন জোটের বোমা হামলা। সেই সাথে সারা বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থীর আত্মঘাতী হামলা। ইন্টারনেটে মাঝে মধ্যেই প্রচারিত হতো শিশুদের নিথর দেহের ছবি। বড় করুন, বড় বেশি পীড়াদায়ক সেই সব ছবি দেখে দেখে নিজের মনটাকে ধরে রাখতে পারলাম না! ভাবলাম প্রভু আমাকে লেখার শক্তি দিয়েছেন, না লিখলে পরকালে তার কাছে কি জবাব দিব? আমি জানি, আমার লেখা পড়ে এ সময়ের যুদ্ধবাজ, প্রতিহিংসা পরায়ণ মানুষগুলো পরিবর্তিত হবে না। তবুও সামান্য পানির আঘাতে আঘাতে বিশাল শিলা খণ্ডের বুকে যেমন পরিবর্তন আসে। এটা তেমনি এক আপাত বৃথা চেষ্টা!]

 

হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে কামাল হাসেমীর মৃতদেহ। এখনো তার হাতের মুঠিতে ধরা ছোট চার বছরের শিশুটির ছবি। অপূর্ব সুন্দর, নিষ্পাপ একটি শিশুর ছবি। শিশুটির কালো বড় বড় চোখ, মায়াবী চাহনি। কালো চুল। সুন্দর হাসি। টোল পড়া ভরাট গাল, ঠিক পাকা আপেলের মতো লালচে আভা ছড়াচ্ছে।

একটু পেছনের কথা বলি,  মৃত কামাল হাসেমী আর ডাঃ আবেদ ইসলাম বাল্য বন্ধু। কামাল উচ্চ শিক্ষিত। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৩৭ বৎসর। পুরোপুরি কুসংস্কার মুক্ত, আধুনিক বিজ্ঞান-মনস্ক এক যুবক ছিল কামাল। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, পশ্চিমাদের যুদ্ধ অভিযানে তালেবানদের পতন হলে; আবার ঘুরে দাঁড়াবে আফগানিস্তান। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগবে পাথুরে নির্দয় মানুষগুলোর মনে।

প্রথম যেদিন মারাত্মক আহত হয় কামাল, সেদিনই নিহত হয়েছিল তার চার বছরের মেয়ে ইয়াসমিন। অদ্ভুত সুন্দর, মায়াবী ছিল তার কথাগুলো। শিশুদের অস্পষ্ট উচ্চারণ করা বাক্যগুলো, বুকে নরম পরশ যোগায়। দারুণ ভাল-লাগতো ডাঃ আবেদের। সারাদিনের আহত-নিহতের শোক, কান্না, আর্তনাদ, গোঙ্গানি, বিষণ্ণতা ভুলে আনন্দে ভরে উঠতো তার মন।

ছোট ছোট পায়ে জুতো পড়ে হাসপাতালের করিডোরে কোন বাচ্চা হেটে এলে এখনো চমকে উঠে ডাঃ আবেদ। ইয়াসমিন নাতো? পৃথিবীতে কত অলৌকিক ঘটনা-ইতো ঘটে! কিন্তু তারপর নিরাশ হয়ে ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে সে।

তার বাল্যবন্ধু কামাল ছিল আধুনিক মনস্ক। স্ত্রী বা কন্যাকে পর্দা করতে দিত না। বলতো শরীর ঢেকে মনের নোংরামি বন্ধ করা যায় না। বরং আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মন ও শরীর আলো-বাতাস, প্রকৃতি, মানুষ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ছোঁয়া পেলে কদর্যতা, কুসংস্কার ও কুলশতা মুক্ত হয়। অনেক পড়াশোনা করতো সে। ইউরোপ ও আমেরিকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার ছিল অগাধ শ্রদ্ধা।

নয় মাস আগের সেই দিনটার কথা এখনো ভুলতে পারেনি ডাঃ আবেদ। যথারীতি বিকাল বেলা হাটতে বের হয়েছিল তারা। সে, কামাল ও কামালের মেয়ে ইয়াসমিন। ইয়াসমিন দৌড়ে আগে চলে যাচ্ছে দেখে পেছন পেছন ছুটলো কামাল, ছোট ছোট পায়ে টুক টুক করে দ্রুত দৌড়াচ্ছে মেয়েটি। তাল মেলাতে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল সেও। পকেট থেকে চশমাটা পড়ে যাওয়ায় আবেদ তুলে নিয়ে ছিল সেটা। হঠাৎ দেখতে পেল, পূর্ব আকাশে একটা এফ-১৬ জঙ্গি বিমান কান ফাটা গর্জনে বোমা ফেলে চলে গেল। একটা বোমা পড়লো ঠিক ইয়াসমিনের সামনে। বোমার আঘাতে শূন্যে উড়ে গেল মেয়েটির দেহ। রাস্তার পাশে পড়ে কামাল। দ্রুত দৌড়ে সেখানে পৌঁছল ডাঃ আবেদ। ইয়াসমিনকে কোলে তুলে দৌড়ালো তার কর্মস্থল হাসপাতালের দিকে। বাল্যবন্ধু আহত পড়ে রইলো রাস্তায়, সেদিকে ফিরেও তাকালো না সে। ইয়ামমিনের ছোট দেহটাকে নিয়ে দৌড়চ্ছে সে। গরম রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার বুক, হাত। ছটফট করে কাঁপছে মেয়েটি। তবুও কোন চিৎকার করছে না, কাঁদছে না।

হাঁপাতে হাঁপাতে হাসপাতালের মেইন গেটে এলো ডাঃ আবেদ। তাকে দেখে এগিয়ে এলো দারোয়ান হামিদ মুহাম্মদ, ইয়াসমিনের ক্ষুদ্র দেহটা তুলে নিলো সে। ছুটলো হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দিকে। পেছন পেছন ছুটছিল ডাঃ আবেদ।

সেদিন বিকেলে। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে পরে আছে শিশু ইয়াসমিনের মৃত দেহ। কালো চুল গুলোতে, কালচে রক্ত জমে আঠালো হয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাসে রক্তশূন্য। যদিও বুক আর পেট পুরুটা বোমার স্পিনটারে ক্ষত-বিক্ষত, আগুনে পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তবুও অদ্ভুত সুন্দর, নিষ্পাপ চেহারা শিশুটির!

ডাঃ আবেদ নিঃসন্তান। তাই কামালের কন্যা ইয়াসমিনের জন্য তার এবং তার স্ত্রী জোহরা বানুর মমতা কোন অংশেই পিতা-মাতা অপেক্ষা কম ছিল না। নাহ, হয়তো ছিল? ইয়াসমিনের মৃত্যুর দুঃখ কাটিয়ে উঠে প্রতিদিন অসুস্থ, আহতের চিকিৎসা করে চলছে সে। কামাল কখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সন্তানের মৃত্যু শোক। প্রথম কয়েক দিন তীব্র ব্যথা ও জ্বরের ঘোরে ইয়াসমিন, ইয়াসমিন্ করে কাদঁতো সে। তার সপ্তাহ খানেক পর অপারেশন করে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল কামালের ডান পা।

বাসায় ফিরে মৃত মেয়ের ছবি, জামা-কাপড় আঁকড়ে ধরে প্রতিদিন কাদঁতো কামাল। আস্তে আস্তে তার চোখগুলো বড় হয়ে আসতো। অনেকটা কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইতো সেগুলো। উন্মাদ বা খুনিদের মতো ভয়ংকর দেখাতো তাকে। প্রলাপ বকতো, ‘আমিও তোদের দুঃখ দেব! এমনি করে কাঁদতে হবে তোদের।’

ঘুমের ওষুধ ও বিষণ্ণতা রোধী ওষুধ দিয়েছিল কামালকে। তবুও দিন দিন কামালের মধ্যে বাড়ছিল হিংস্রতা। প্রায়শই স্ত্রীকে মারতো সে। অথচ কদিন আগে স্ত্রী ও কন্যা ছিল তার প্রাণের চেয়ে প্রিয়। কি না ভালবাসতো সে স্ত্রী কে!

কামালের স্ত্রী নিগার একে একে ইয়াসমিনের সব ছবি, জামা-কাপড়, ছোট ছোট বালিশ, চাদর সব কিছু লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল ডাঃ আবেদের বাসায়। কেউকে জানতে দেয়নি সেটা। সেজন্য সেদিনও স্ত্রীকে মেরেছিল কামাল। তবুও একটু কাদেঁনি নিগার। তার এখন আর কান্না হয় না। অশ্রু শুকিয়ে গিয়েছে বেশ কদিন হলো!

হঠাৎ একদিন ব্যাংক থেকে সব টাকা তুলে নিলো কামাল। সবার অজান্তে, নিজের থাকার বাড়ীটাও বিক্রি করে দিয়ে ছিল সে। স্ত্রী কে পাঠিয়ে দিল গ্রামের বাড়িতে। তারপর হঠাৎ নিরুদ্দেশ। এমন কি বাল্যবন্ধু আবেদকেও জানালো না কিছু। কামাল নিরুদ্দেশ ছিল প্রায় চার মাস।

তারপর এগারো দিন আগে হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে আসলো কামাল। শুকিয়ে রোগা হয়ে গেছে। মুখে লম্বা লম্বা দাড়ি-গোঁফ। শরীরে কয়েকটা ক্ষত-চিহ্ন। শরীরে ভীষণ জ্বর। কথা বলতে বলতে হঠাৎ জ্ঞান হারালো সে। সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল আবেদ। অবস্থা ভাল নয় বুঝে, গ্রামে কামালের স্ত্রীকে আসতে জরুরি খবর পাঠালো আবেদ!

গত তিন দিন ধরে প্রচন্ড জ্বরে ভুগছিল কামাল। তার শরীরের পুরনো আঘাত স্থানে আবার ইনফেকশন হয়েছিল।

গতকাল মৃত্যু আসন্ন বুঝতে পেরে, বন্ধুকে অনুনয় করছিল কামাল, ‘শেষ বারের মতো আমার ইয়াসমিনের একটা ছবি আমার হাতে দাও। চুমু খেয়ে, বুকে ধরে মরে যাই’। ইয়াসমিনের সব ছবি নিজের সাথে নিয়ে গিয়ে ছিল তার মা নিগার সুলতানা। আবেদের বাসায় ছিল একটা ছবি! কিন্তু কামালের ভয়ে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল; কিছুতেই খুঁজে পেল না সেটা।  অগত্যা  ইউরোপের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত একটি শিশুর ছবি, খবরের কাগজ থেকে কেটে দিয়ে ছিল আবেদ।

ছবিটির পুরো দৃশ্য ছিল এরকম, গতকাল ইউরোপের রাস্তায় আত্মঘাতী গাড়ী হামলায় নিহত হয়েছে আঠারো জন। তন্মধ্যে পিতা-মাতার সাথে নিহত হয় এই শিশুটি। রাস্তায় ঘাতক গাড়ী, রক্তাক্ত মানুষ আর চাদরে ঢাকা ছিল শিশুটির লাশ। ইনসেটে শিশুটির ছবি। আফগানিস্তানের প্রায় সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সেই ছবি। কেউ কেউ হয়তো খুশি হয়েছিল! আবার হয়তো ছবিটি দেখে দুঃখ পেয়েছিল অনেকে।

কামালের মেয়েটি ছিল অনেকটা গতকাল পত্রিকায় ছাপানো ইউরোপীয় শিশুটির মতোই। সুন্দর গোলগাল চেহারা। ফুটফুটে হাসি। তাই কামাল বুঝতে পারে নি। ছবিটি নিয়ে চুমু খেল কামাল, বুকে জড়িয়ে ধরে গভীর একটা শ্বাস নিলো, তারপর মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরলো সে। তার হাতে পরম মমতায় এখনো জড়িয়ে ধরা আছে সেই ছবিটি।

কামালের স্ত্রী নিগার এসেছে দুই ঘণ্টা হলো। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। পুলিশের সহকারী সুপারেনটেন্ড জহির; কামাল ও আবেদের কলেজের বন্ধু। সে জানালো, মৃত্যুর পূর্বে জঙ্গি দলে যোগ দিয়েছিল কামাল। তার জীবনের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ দিয়ে এসেছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে। কামালের টাকায় প্রশিক্ষিত হয়ে, গত পরশু ইউরোপের রাস্তায় আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে এক আফগান যুবক। আর সেই হামলায় নিহত হয়েছিল ইয়াসমিনের মতো ফুটফুটে চার বছরের একটি নিষ্পাপ মেয়ে। যার ছবি বুকে জড়িয়ে গতকাল মৃত্যুকোলে ঢোলে পরেছিল কামাল।