আজ রবিবার, ৪ঠা মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই আন্দোলনে আহত বিএনপি কর্মী এখন ‘মামলা ব্যবসায়ী’

editor
প্রকাশিত মে ৩, ২০২৫, ০১:৫৩ অপরাহ্ণ
জুলাই আন্দোলনে আহত বিএনপি কর্মী এখন ‘মামলা ব্যবসায়ী’

Oplus_16908288

Sharing is caring!

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর কবির:
নিজেকে বিএনপি কর্মী দেওয়া মো. নূর মোহাম্মদ (রনি) উত্তরায় জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিতে আহত হন।
ঢাকা মহানগর হাকিমের আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দায়ের করেন। অভিযোগপত্রে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-১৮ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য হাবিব হাসান খসরু চৌধুরীসহ ৩৩ জনকে আসামি করেন।
আন্দোলন চলাকালীন হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগে প্রথমে মামলার অভিযোগপত্রে নাম, পরে লোক লোক পাঠিয়ে নাম কাটানোর প্রস্তাব দিয়ে উত্তরায় বিভিন্ন জনের কাছে মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি করছেন নূর মোহাম্মদ (রনি)।
 দাবিকৃত টাকা না পেলে করছেন হয়রানি, দেখাচ্ছেন ভয়ভীতি। এসব হয়রানি থেকে বাদ যাচ্ছে না রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকা সাধারণ মানুষও।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, নূর মোহাম্মদ (রনি) মামলার ভয় দেখিয়ে টার্গেট করা ব্যক্তিদের কাছে তার সহযোগীদের পাঠান টাকা আদায় করার জন্য। এ সংক্রান্ত একাধিক কল রেকর্ড ও সিসিটিভি ফুটেজ গণমাধ্যমে রয়েছে।
নূর মোহাম্মদ রনির মামলার আসামি উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া মাহবুব। মাহবুবের দাবি, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি সেক্টর কল্যাণ সমিতির নিরাপত্তা ও দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আন্দোলন চলাকালীন তিনি সপরিবারে কানাডায় তার ভাইয়ের বাসায় ছিলেন। তিনি আন্দোলনের ১ মাস পর দেশে ফেরেন। সেই মামলার পাশাপাশি উত্তরায় জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত এক ব্যক্তিকে পেটানোর অভিযোগে ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে তাকে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ মার্চ রাজিব নামের একজনকে নজরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কাছে পাঠিয়ে তিন লাখ টাকা দাবি করা হয়। বিনিময়ে মামলা থেকে নজরুল ইসলামের নাম বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী মাহবুবের অভিযোগ, সম্প্রতি ‘রাজিব’ নামের এক ব্যক্তি তার বাসায় গিয়ে জানান, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের হয়ে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার একটি মামলায় তার নাম রয়েছে।
রাজিব একটি কাগজ দেখিয়ে মামলা সংক্রান্ত তথ্য এবং তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের হুমকি দেন। এ সময় বিচলিত না হয়ে মাহবুব রাজিবের পরিচয় এবং মামলার বিস্তারিত জানতে চান। তখন তিনি তাদের কথোপকথন ভিডিওতে ধারণ শুরু করেন।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়— মাহবুবের প্রশ্নের জবাবে রাজিব মো. নূর মোহাম্মদ রনিকে ফোনে যুক্ত করেন, যিনি নিজেকে মামলার বাদী হিসেবে পরিচয় দেন। কিন্তু কথা বলার একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি বলেন, ‘রাজিব ভাই জানেন… আমি না।’ আবার পরে বলেন, ‘হ্যাঁ, আপনার নামে মামলা হয়েছে।’ মাহবুব জানতে চান, ‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘না, আমি আপনাকে চিনি না… রাজিব ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন।’
এরপর তিনি আরও বলেন, ‘আমি তো আপনারে (মামলা) করিনি আঙ্কেল, এটা অন্য কেউ করেছে। রাজিব ভাই কইছে আপনার নাম দিতে। আমি তো আপনার নামটাও পুরো জানি না।’
আরও বলেন, ‘মামলা তো অনেকেই করছে, অ্যাডভোকেটরাও অনেক নাম ঢুকাইছে। রাজিব ভাইয়ের সঙ্গে বসেন, আমি সব ঠিক করে দিবো। আপনারা যেমন পারেন করেন, দরকার নাই আঙ্কেল।’
নজরুল ইসলাম মাহবুব প্রশ্ন তুলেছেন, ‘যারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত না, দলীয় সুবিধাও নেয়নি, তারা কেন প্রতিহিংসার শিকার হবে? এ সময় তিনি প্রশ্ন তুলেন— সমাজের দায়িত্বশীল একজন মানুষ হিসেবে কাজ করাটাই কি আমার অপরাধ?’
স্থানীয় একাধিক সচেতন নাগরিক বলেন, এটি যে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানি, তা স্পষ্ট। এভাবে একজন নিরীহ সমাজসেবককে বারবার টার্গেট করা অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য।
এর আগেও একই ধরনের এক অভিযোগে মাহবুবকে থানায় ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল এবং দুই দিন পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকি একবার মসজিদ থেকে ফেরার পথে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়, যা বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমেই তিনি নিজেই ফোন রিসিভ করেন। চাঁদা দাবির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজিব জানান, নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া মাহবুব নামের কারো কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছে কিনা— সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
 পরে আবার ফোন দিয়ে বলা হয়, ‘রাজিব বর্তমানে বাইরে আছেন। তিনি ফিরে এলে ফোনে যোগাযোগ করবেন।’ চাঁদাবাজি নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলেও তিনি বলেন, পরে ফোন দেবেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, রাজিব নামে আমাদের বিএনপি বা অঙ্গসংগঠনে কেউ নেই এবং কোনো কালেই ছিল না। যিনি ভুক্তভোগী, তাকে বলেন মামলা বা থানায় অভিযোগ করতে। প্রয়োজনে আমরাও তাকে সহযোগিতা করব।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব হাজি মোস্তফা জামান বলেন, বিএনপির নাম ভাঙিয়ে কেউ বিন্দু পরিমাণ অপকর্ম করলে আমরা ছাড় দেব না।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাফিজুর রহমান মামলার বিষয়ে জানতে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম (অতিরিক্ত ডিআইজি) বলেন, ‘চাঁদাবাজির ব্যাপারে আমরা সবসময় জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল। যদি কোনো ব্যক্তি হয়রানিমূলক মামলার আসামি হন এবং প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয় যে তিনি সেই মামলায় জড়িত নন কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, তবে তদন্ত সাপেক্ষে বাদীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একইভাবে কেউ যদি মামলা বা আইনি প্রক্রিয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে চাঁদাবাজির চেষ্টা করে এবং এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ জানায়, তাহলে অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’