আজ মঙ্গলবার, ২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভাটির হাওরে : ক্ষেতমজুররাই নব্য উৎপাদক শক্তি

editor
প্রকাশিত মে ১৯, ২০২৫, ০৩:০২ অপরাহ্ণ
ভাটির হাওরে : ক্ষেতমজুররাই নব্য উৎপাদক শক্তি

Sharing is caring!

মোঃ ওবায়দুল হক মিলন,সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
ক্ষেতমজুররা ভাটির হাওর দাপিয়ে চাষ করছেন। আজ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য গোটা হাওর চাষাবাদ করে তারাই ক্ষেতখলা চাষযোগ্য রাখছেন। এই ক্ষেতমজুরদের প্রায় সারাদেশেই বলা হতো কামলা বা ক্ষেত-কামলা। এই কামলারা সমাজে খুব দীনহীনভাবে বেঁচে থাকতো। অতীতে অন্ধ মান বণ্টন ও অগ্রগতির ফলে সমাজ মানুষের ও সমাজের নানাভাবে অসমরূপ ধারণ করে। ফলে সমাজের অন্য শ্রেণির মানুষদের জমি ও অন্য সম্পত্তি থাকলেও এই কামলাদের দেহ বা শারীরিক শক্তি ছাড়া সম্পত্তি ছিলো না। অতীতর অন্ধ চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় ও কৃষিকাজে এই শারীরিক শক্তি ছিলো এক অপরিহার্য উপাদান। মানুষ হিসেবে তাঁদের মূল্যায়টা এমন কিছু কথাই ছিলো— ‘নেংটির নিচে কাপড় নাই, আর কামলার নিচে মানুষ নাই’। এমনও তুচ্ছার্থে বলা হতো ‘গামছাও একটা কাপড়, আর কামলাও একটা মানুষ’! কিন্তু এই কামলা ছাড়া কৃষি অঞ্চলের কৃষকরা যে অচল তা বুঝতে, তাঁদের প্রায় ষাটোর্ধ্ব বর্ষ পেরিয়ে গেলো। ২০২৫ সালে দিকে এসে এর সত্যতা প্রমাণিত হলো। আমার লেখায় আজ এই বিষয়ের দিনচিত্রটাই দেখাতে চেষ্টা করেছি।
এককালে এই ক্ষেত-কামলারা সমাজের গৃহস্থ কৃষকদের বাড়ি বাড়ি হানা দিতো ঘুরতো অনুনয় বিনয় করতো বদ্ধ (আ-বদ্ধ) হওয়ার জন্য। বদ্ধ হওয়া মানে ছ’মাসের জন্য নিজেকে সপে দেওয়া বা তার শ্রম বিক্রি করে দেওয়ার জন্য। কামলার পরিমাণ এত বেশি ছিলো যে সুঠাম এবং পারদর্শী কামলারাই অগ্রাধিকার পেতো। বাকি দুর্বল, বয়স্ক, কম সবল ও সামান্য কাজ জানে এমন আশি ভাগ কামলাই ভালো গৃহস্থ বাড়িতে বদ্ধ হতে না পেরে আফসোস করতো। ত্রিশ/চল্লিশভাগ বড় ও সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে বদ্ধ হতে পারলেও ষাটভাগ কামলা বদ্ধ হতে না পেরে রোজ-কামলার ওপর ভর করে বউ-বাচ্চা নিয়ে মানবেতর বছর পোহাতো। কেননা আজকের মতো শ্রমো-স্রোত তিরিশ বছর আগেও ছিলো না যে, অন্যত্র অন্য জেলায় চলে যাবে। ফলে কাজ থাক আর না থাক নিজ এলাকাতেই পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কাটাতে হতো। একবার ভেবে দেখুন তো রাষ্ট্রের কোনো সুবিধাই আপনার জন্য বরাদ্দ নেই, শুধু শরীরের শক্তিটাকে পুঁজি করে যদি বউ ছেলে-মেয়ে বাবা-মা’সহ আপনার বেঁচে থাকতে হতো কেমন লাগতো!
অবস্থাটা ছিলো এমন গরিব যেমন শুধু এক ধরনের গরিব নয়, তেমনই কৃষকও সবাই একই মাপের গৃহস্থ নয়। এই ছোট বড় কৃষক-গৃহস্থ বাড়িগুলিই ছিলো এই কামলা বা আজকের ক্ষেতমজুরদের আশ্রয়স্থল। তখনকার পরিসংখ্যানে একটি গ্রামে বড়জর তিন থেকে চারটি বাড়িতে ছোট-বড় গৃহস্থ ছিল, বাকি ছয়টিই জমিশূন্য দিনমজুর পরিবার। অর্থাৎ একসময়ে অনুপাতটা চল্লিশ-ষাট থাকলে এ খরা-বন্যায় ফসলহানি আর ফসলের দাম না পেয়ে অনুপাতটা এসে দাঁড়িয়েছে বিশ-আশিতে। বলা চলে প্রান্তিক কৃষক যাঁরা ছিলো তারাও এসে পাল মিলিয়েছে কামলা দেওয়ার দলে। অন্যপক্ষে ছোট কৃষকরা জমি হারানোয় মাঝারি ও বড় কৃষকরা একটা পর্যায় পর্যন্ত আরও বড় হয়েছে। বলা যায় এ ভূখণ্ডের কৃষকদের এটাই ছিলো জমির মালিক হওয়ার বিশেষ সময় তথা স্বর্ণযুগ। সময়টা নির্ধারণ করে বলতে গেলে পাকিস্তান আমলের কিঞ্চিৎ পূর্ব থেকে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর দুই দশক পর্যন্ত।
বলা চলে অবস্থাপন্ন বড় কৃষক পরিবারগুলি ছিলো এক একটা ছোটখাটো মৌসুমি ধান উৎপাদন কারখানার মতো। তিরিশ হাল চল্লিশ হাল জমির গৃহস্থি করতো, পঁচিশ তিরিশটি কামলা রাখতো। গরু রাখাল, পাচক-মহিলা, হাট-বাজারি দুজন ধান উড়ানির, খাতা লিখা ম্যানেজার মিলিয়ে আরও চার-ছ’জন যোগ হতো কামলা দলের সঙ্গে। বলা যায় আশ্বিন মাস থেকে তিরিশা জৈষ্ঠ্যের করমাদি সংক্রান্তি পর্যন্ত আট মাসের এক মহা হুলুস্থুলের মহা কর্মযজ্ঞ। ছয় মাসের কামলা বললেও সময়টা পুরো আট মাসের শেষদিনে করমাদির ফলারসহ ভালো মাছ মাংস আম-কাঠালর ভালো খানাদানার পর চোখের জলে এর বাৎসরিক পরিসমাপ্তি ঘটতো। অপরপক্ষে কামলা বলতে বুঝাতো গৃহস্থালি সর্বকাজে পারদর্শী লোক। বোরো ফসলের জমিতে সাধারণত চারজন লোক এক বিঘা বা কেয়ার জমি রোপণ করতে পারে। আরও ভালো কামলা হলে দুইজনেই সেইটুকু জমি লাগাতে পারে। যে একাই এক কেয়ার জমি (রোপণ) লাগাতে পারে সেইসাথে বাঁশের বেত আঁশাতে পারে উড়া পাইলা ডুলি কুলা কাঠা ধারি তথা বাঁশ-বেতের সর্বকাজসহ গাই-দোয়াতে জানে সে-ই সর্বশ্রেষ্ঠ কামলা। তাঁর বেতন বোরো ফসলের গৃহস্থের ঘরে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মণ এতে কোনো ভুল নেই। বাকিরা কাজের ধরন-মান বুঝে পনেরো থেকে পঁচিশ মণ ছিলো।
ধনী গৃহস্থ পরিবারগুলিতে প্রতি হালে (৪ একর) একজন করে কামলা হিসেবে বিশ হাল জমির গৃহস্থি হলে, উদ্বৃত্ত শ্রমকে হিসেবে রেখে পনেরো জন কামলা রাখলেই চলতো। সেইরূপভাবে পঁচিশ তিরিশ চল্লিশ হাল (১৬০ একর) জমি চাষ করলে তিরিশ জন কামলা ও সাথে অন্যান্য সহযোগী কামলার হিসাব করা হতো। এসব গৃহস্থালিতে দশ-পনেরোটি গরুর গাড়ি যখন হাওরের বুক চিরে নিথর নিরবতাকে আন্দোলিত করে মাড়াই-খলার ধান নিয়ে বাড়ির পানে ছুটতো এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হতো। কিন্তু প্রতিটি বাড়িতে ছ’মাসি এত কামলা থাকার পরও পৌষের সকালে হাওরের বিভিন্ন গোপাটে শ’তে হাজারে রোজ-কামলার লাইন দেখে যেতো। রোজিনা কাজ না পেয়েও কত কামলা ফেরৎ গেছে। সকালে বেলা ন’টা বেজে গেছে তো এদিন আর কপালে কাজ ঝুটে নাই।
এমনই ছিলো তখনকার কামলা বা খেটে খাওয়া মানুদের জীবন। সকাল আটটায় গৃহস্থের ক্ষেতে কাজে লাগতে হতো সন্ধ্যায় অন্তত (দশ ঘণ্টা) ছয়টা পর্যন্ত কাজে থাকতে হতো। ক্ষেত থেকেই বাজারে গিয়ে হাট-বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে নিত্যকর্ম খাওয়া দাওয়া সেরে আটটায় ঘুমাতে হতো। কী অবর্ণনীয় কষ্ট আর সময়বাঁধা নিয়ম নিয়ে যে এ শ্রণির মানুষদের জীবন অতিবাহিত হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। জমিদারি আমলের শেষপাদে রাষ্ট্রীয় মুদ্রা-মানের অতি সংকোচন নীতির ফলে আমার এভূখণ্ডের টাকার মান ছিলো বেশি। মুক্তিযুদ্ধের পর পর্যন্তও ভারতের রুপির চাইতেও আমার দেশের টাকার মান বেশি থাকতো। তাতে কম টাকায় অনেক দ্রব্যসামগ্রী কিনতে পারলেও সাধারণ মানুষের হাতে টাকা তো প্রায় উঠতোই না। এ শ্রেণির মানুষেরা কালেভদ্রেও একশ’ টাকার নোট দশ বছরেও আশিভাগ মানুষ দেখেছেন বলা যাবে না। দশ/বারো টাকা মণ ধান আট আনা সের চাল দেড়টাকা সের ডাল দশআনা সের তেল পঁঞ্চাশ/ষাট টাকা ভরি স্বর্ণ এখন শুনতে আনন্দ লাগলেও সাধারণ মানুষ থাকতো টাকাশূন্য।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দেড় দশকে দুইবার সামরিক শাসনের কবলে মানুষ পিষ্ঠ হয়েছে। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে বাড়তি টাকা ছাপানোতে সাধারণ গরিব মেহনতি মানুষের হাতে কিছুটা টাকা পৌঁছলেও মূল্যস্ফীতির কারণে এ টাকা ধরে রাখতে পারতো না। এভূখণ্ডে কখনও কাম্য জনসংখ্যা অনুপাতে টাকা ছাপানো হয়নি, শাসকের স্বার্থে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালে অধিক হারে মুদ্রা সংকোচন নীতি পরবর্তীতে জনসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু অর্থনীতিতে অতি মুদ্রাস্ফীতি নীতির ফলে গরিব কামলা শ্রেণির মানুষকে সব সময়ই অর্থহীন অর্থনীতির যাতাকলেই বেঁচে থাকতে হয়েছে। আশির দশকের শুরুতে ক্ষেতে খামারে কাজ করে এমন মেহনতি মানুষেরদের শক্তি যোগাতে ও ঐক্যবদ্ধ করতে ক্ষেতমজুর গণফ্রন্ট গঠন করা হয় নাম দেওয়া হয় “বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি”। এরপর পরই তথা দশকের মাঝামাঝি পাকি-শাসকের মতো এক সামরিক জগদ্দল পাথর সরাতে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। তখন বাম রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলন প্রভূত ভূমিকা ছিলো। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বাম রাজনীতির আন্দোলনে অনেকাংশে নির্ভরশীল ও অপেক্ষমান থাকতে দেখা গেছে। তখন শহুরে গরিব মেহনতি মানুষেরা এ আন্দোলনে যোগদেয়। গ্রামীণ এলাকায় ‘ক্ষেতমজুর সমিতি’ ব্যাপক হারে গড়ে ওঠে এবং নিজস্ব দাবি-দাওয়া নিয়ে এগিয়ে আসে। এই বাম রাজনীতিতে গ্রামীণ খেটে খাওয়া মানুষদের জীবন যাত্রা নিয়ে আলোচনা বক্তৃতা বিশ্লেষণ থেকে এই শ্রেণির মানুষেরা তাঁদের জীবনের ফাঁকির দিকটি ক্ষাণিক বুঝতে পারে। তাঁরা নিজেরাই হিসেব বিশ্লেষণ করে দেখে যে কামলার চূড়ান্ত দর্মা তিরিশ মণ হলেও গৃহস্থ-মহাজনকে দেড়াসুদে বেতন কাটিয়ে তাঁর আসল মজুরি বা বেতন হয়ে যায় ঊনিশ/একুশ মণ। এভাবে পঁচিশ, বিশ, পনেরো মণ ধানে যাঁরা চাকুরি খাটে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একই শুভঙ্করের ফাঁকি। অথচ চাকুরি ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বেতন বা মাহিনা যে বিন-সুদি দেওয়ার কথা তা মহাজনের কাছে পায় না। তাই তাঁরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে বুঝাপড়া করে হিসেব করলো ছয়/আট মাসের জন্য গৃহস্থের ঘরে আ-বদ্ধ হয়ে থাকা লাভজনক নাকি সারাবছর তিন শ’ টাকা করে রোজ-কামলা দেওয়া ভালো। পরিণতিতে দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলো গ্রমীণ ক্ষেত-কামলা তথা ক্ষেত মজুররা।
এই ক্ষেতমজুর নামটা নিয়ে একটু আপত্তি এই গণফ্রন্ট গঠনের শুরুতেও ছিলো আজ চৌত্রিশ বছর পর সারাদেশে সবার কাছেই প্রণিধানযোগ্য হবার কথা। কেননা যাঁরা ক্ষেতে কাজ করতে পারে শুধু তাঁরাই কামলা বা মজুর তা নয় এর বাইরেও অনেক মজুর আছে যাঁদেরকে এখানে টানার সুযোগ রাখা হয় নাই। তাই অনেকের মতে নামটা ‘গ্রামীণ মজুর’ হলে জুতসই হতো। যাক্, নীতি নির্ধারক মহল এ নিয়ে ভাববেন, আমি শুধু জন-ইচ্ছা বা জনমতটা এখানে তুলে ধরলাম। লেখার শেষদিকে সময়ের প্রেক্ষাপটে আমি তাঁদের অন্য একটি পরিচয় ও চারিদ্র্য তুলে দেখাবো সব মিলিয়ে, সুবিবেচনা প্রসূত নাম নিয়ে না হয় তখন ভাবা যাবে।
এবার মূল লেখায় চলে যাই, যা বলছিলাম—নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই কামলারা আস্তে আস্তর গৃহস্থবাড়িতে বদ্ধ হওয়া বন্ধ করে দেয়। কৃষকরা প্রথমত একটু উষ্মাই প্রকাশ করলো যে কামলা বদ্ধ হবে না তো খাও কেমনে দেখি ! তবু কৃষকরা কামলার মূল বেতন ও তাঁর মাসিক পারিবারিক প্রয়োজনে নিয়ম মাফিক পাওনা পরিশোধে অনিচ্ছুক। কেননা কৃষকেরও তো ‘নাও টানার থেকে পাও টানা বড়’ হয়ে যায়। তিনিও তো ঋণ করেই সারা মৌশুম গৃহস্থির ব্যয় নির্বাহ করেন। রাষ্ট্র বা সরকার কি আর কৃষকের মামু-চাচা হয় যে নিজে ব্যাংক ঋণের সুবিধা পাবে আর কামলাকে দেবে! দেশের অন্য এলাকায় একই মৌসুমে একই জমিতে দু’টি তিনটি ফসল হয় কম কম করে হলেও বাড়তি আয় বেশি হয় বলেই কামলার দৈনিক মজুরি সেখানে সাত/আটশ’ টাকা, অঅথ্যাৎ আনুপাতিক হারে বেশি দিতে পারে। এক ফসলী বোরো এলাকায় দেওয়া সম্ভব নয়। হাওর এলাকায় বেশি জমি চাষ না করলে গৃহস্থ কৃষকের পর্তা পড়ে না তাঁদের পক্ষে বেশি দর্মা-রোজিনা দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বটা কৃষক আর কামলার মধ্যে হলেও নিরসনের জন্য রাষ্ট্র এগিয়ে না এলে কিছুতেই সমধান সম্ভব নয়। যাক্, রাগ গোস্সা দেখিয়েও অগত্যা রোজ-কামলা দিয়েই কিছুদিন হাল-গৃহস্থি চলল ঠিকই দশককাল পড়ে কৃষক বুঝতে পারলো দিন বদলে গেছে।
অপরপক্ষে কামলারা রোজকার আয়ের ওপর ভর করে ধিকিধিকি চালে চললো আর নতুন দিনের নতুন পথ খুঁজতে লাগলো। কথায় আছে না-’প্রয়োজন নিয়ম মানে না’ তেমনই ‘প্রয়োজন ভয়ও মানে না’। শুরু হলো নিজ এলাকায় যতদিন পাওয়া যায় রোজে কামলা দিয়ে কোনো রকম চলা আর এলাকায় কাজ ফুরিয়ে গেলে অন্য দূর-দূরান্তের জেলায় চলে যাওয়া। অন্য একটি সুযোগও তাঁরা খুঁজে পেলো, আগে অন্য জেলার ভাগালো এলাকায় ধানকাটতে আসতো এখন আসে না। ফলে এ এলাকার কামলারা অন্য জেলায় কাজ করতে যাওয়ার পাশাপাশি ধানকাটার কাজটিও পেয়ে গেলো। নব্বই দশক থেকে টানা তিন দশক ক্ষেতমজুররা নিজ এলাকায় ‘দিনমজুরি’ মৌসুমি ‘ভাগালো’ ও কাজ না থাকে সময় ‘ভিন জেলায়’ রোজে কাজ করে মোটামুটি ভালোই চলছে। এর মধ্যে গত তিরিশ বছর কৃষকের জমি ‘নগদ-জমা’য় রেখে প্রথমত দুই তিন (বিঘা) কেয়ার আস্তে আস্তে সাহস করে পাঁচ/ছয় কেয়ার এখন প্রতি ক্ষেতমজুর বারো চৌদ্দ কেয়ার জমি চাষ করে। ফলে প্রত্যেক ক্ষেতমজুরের মাচায় আশি থেকে দেড়শ’ মণ ধান ওঠে। তাতে আয় খুব ভালো না হলেও জমির মালিক কৃষকের চাইতে একটু ভালোই মোরাদ হয়। কেননা সে অন্যের ক্ষেতে রোজ-কামলা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর নিজের ক্ষেতের সার কীটনাশক কেরোসিনের ব্যয়টাও অনেকটা ঋণ ছাড়াই চালাতে পারে। আমি নিবন্ধের লেখায় অনেক ক্ষেত্রেই হাওর এলাকার চিত্র শুধু দেখিয়েছি প্রশ্ন থাকতে পারে অন্য এরাকায় কি ক্ষেতমজুর নেই ? আছে। অন্য এলাকায় দু’তিন ফসলি জমি এবং এত জমির মালিক সেখানে নেই। হাওর এলাকা দেশের এক অষ্টমাংশ মানে সাত হাজার বর্গমাইল আয়তনের একটি জলাভূমি এলাকা। এখানকার চিত্রটা দিয়েই সারাদেশের ক্ষেতমজুরদের জীবনচিত্র দেখিয়েছি। লেখার নামটা ‘হাওরে ক্ষেতমজুর বিপ্লব’ দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু নিজে একটু জমি চাষ করে ক্ষেতমজুরদের একটু স্বাচ্ছন্দ্য বাড়লেও জীবনের অন্যান্য পাওনাগুলি সেই ছন্দে আসে না এবং আসেও নাই তাই ‘নব্য উৎপাদক শক্তি’ বলেছি।
বিশের দশকের শুরুতে হার্ভেস্টার মেশিন আসার পর ক্ষেতমজুরদের ধানকাটার আয়ে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে তাতে তাঁরা অনেকটাই দমে যায়। তবে ধানের দামটা একটু বেশি পাওয়ায় আপাতত টিকে থাকতে পারছে। কিন্তু এখন ২০২৫ সাল পর্যন্ত হাওরে তিরিশ হাল চল্লিশ হাল জমির গৃহস্থ তিন/চার হালের গৃহস্থে নেমে এসেছে। এর উপরে ছয়/সাত হাল জমির গৃহস্থি করার মতো কৃষক হাওর এলাকায় নেই। এতবড় গৃহস্থ হাওর এলাকায় যেহেতু নেই, দু’ফসলি তিন ফসলি এলাকায় এত জমির মালিক আগেও ছিলো না এখনও নেই। তাই একটি কথা মোটামুটি পরিসংখ্যান দিয়েই বলা যায় যে, রাষ্ট্রীয় ঋণ/ধানের দাম ইত্যাদি সুবিধার অভাব, কামলার অপ্রতুলতা, পাওয়ারটিলার, হার্ভেস্টারে ধান কাটার কড়া চার্জ এসব অসুবিধার কারণে মূল কৃষক জমিচাষ-গৃহস্থালি ছেড়ে দিলেও ক্ষেতমজুররাই সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে দেশের জমি বিশেষ করে হাওরের জমি আবাদ রাখছেন। আগামী দিনে সেটা যে আরও সংহত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং আমিসহ অনেক ভবিষ্যবক্তার অভিমত এঁরাই একদিন এই সমাজে নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে পরিণত হবে। কেননা আজ পর্যন্ত এই ‘ক্ষেতমজুর’রা তাঁদের নিজেকে ক্ষেতমজুর নামে পরিচয় দিতে অপমানিতবোধ করেন। তাঁরা নিজেদের ছোট কৃষক বা প্রান্তিক কৃষক বলতে অনেকটাই উৎসাহিতবোধ করেন।
লেখক : কৃষক-ক্ষেতমজুর ও হাওর আন্দোলনের সংগঠক