আজ সোমবার, ৩রা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সেই মোহন বাঁশিটি আজ বাংলাদেশের আকাশে বাজলো না!

editor
প্রকাশিত মার্চ ৭, ২০২৫, ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ
সেই মোহন বাঁশিটি আজ বাংলাদেশের আকাশে বাজলো না!

Sharing is caring!

Manual2 Ad Code

কুতুব হিলালী

চোখের পলকে একটি সুন্দরকে, একটি ভূস্বর্গ, প্রিয় জন্মভূমি ও লাল-সবুজের নয়নের অভিরামকে তছনছ হতে দেখে আমার মতো একজন নিরীহ মানুষ, যে কিনা সবসময়ই আঙুল শুকিয়ে লিকলিকে কাষ্ঠখণ্ড (আঙুল ফুলে কলাগাছের বিপরীতে),

Manual3 Ad Code

সেই আমিও রাজপথে নেমে এসেছি। অথচ আমার তো রাজপথে নামার কথা ছিল না! অথবা এই রাজপথ কখনোই আমার ছিল না। এখন রাজপথ আমার সহোদরা, বাংলার পথপ্রান্তর আমার ছেঁড়াজামা, গ্রামবাংলার প্রিয় সবুজ আঙিনা এখন আমার বিক্ষত ও রক্তজর্জর অস্তিত্বের হাড়গোড় ও পরিত্যক্ত দেহখানা। আমার প্রিয় বাংলাদেশ আজ ভালো নেই। আমার জন্মভূমি বাংলাদেশকে আজ ভালো থাকতে দিচ্ছে না।

৫ আগস্ট ২০২৪ বাঙালির আরেকটি পলাশির দিন। আরেকটি ষড়যন্ত্রের দিন। আরেকটি অন্ধকারের খোঁড়লে প্রবেশের দিন। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র প্রবক্তারা শুরু থেকেই চাইছিল না যে, বাংলাদেশ ভালো থাক; বাংলাদেশ সুস্থ থাক; বাংলাদেশ বাঙালিদের হাত ধরে এগিয়ে যাক। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট, সেই তারাই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, যিনি না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই হতো না, সেই তাঁকেই, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। একদল গোমরাহ ও বিভ্রান্ত সেনাবাহিনী কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন আমেরিকার কিছু কূটনীতিক ও পাকিস্তানপন্থিরা ন্যাক্কারজনকভাবে জড়িত ছিল, এ কথা আজ প্রমাণিত।

সেই তারাই ৫ আগস্ট ২০২৪ ঘটালো, সুদীর্ঘ সময় নিয়ে, মেটিকুলাস পরিকল্পনার মাধ্যমে। ঘটনা পরম্পরায় এখন যা মনে হচ্ছে, (তাদের দৃষ্টিতে) বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হওয়াটাই সম্পূর্ণ ভুল ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন না হয়ে যদি সেই পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের কলোনি থেকে যেত, তাহলে তাদের জন্য সর্বার্থেই ভালো ছিল। অবশ্য ৫ আগস্ট ওরফে ৩৬ জুলাই যারা ঘটিয়েছে, তারা এমনটি দাবিও করে বটে। একাত্তর ছিল তাদের কাছে বেহাত বিপ্লব। কারো কাছে গণ্ডগোল। কারো কাছে ষড়যন্ত্র। কারো কাছে ভারতের কাছে পাকিস্তানের পরাজয় অথবা মুক্তিযুদ্ধ কোনো যুদ্ধই ছিল না, এটি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের বৃহত্তম মুসলিম উম্মাহর পতন, এমনতরো আরও কত শত বস্তাপচা ন্যারেটিভ।

একাত্তর কী ছিল আদতে? এমন প্রশ্ন প্রজন্মের মুখে মুখে নিত্য নতুন মোড়কে বারবার ঘোরপাক খাচ্ছে এখন। ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে, সময়ের নানা সংশয় ও সমীক্ষা শেষে প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ কথাটি হচ্ছে, একাত্তর ছিল বাঙালি জনগোষ্ঠীর একটি অনিবার্য অস্তিত্বের সংগ্রাম; শুধু বাঙালিই নয়, আরও আরও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও ভাষাভাষী যারা এই ব-দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বা আছে, তাদের সকলেরই সম্মিলিত বাঁচার লড়াই। এই বাঁচাটা যতটা ধর্মের স্বার্থে, তার চাইতে হাজার গুণ স্বার্থটি বা সত্যটি হচ্ছে, তাদের ভাতকাপড়ের সওয়াল। তাদের ইকোনমি। তাদের ইহতিসাব। তাদের জাগতিক উন্নতি। তাদের নিঃশ্বাসের নিঃস্বন ও স্বতঃস্ফূর্ত বুলির গরজ। তাদের ভূমি ও ভূমিজাত যত ফলফসল ও প্রতিষ্ঠাপ্রবণ যত সিঁড়ি-উপসিঁড়ি, তার ন্যায্য হিস্সা ও সমবণ্টনের সওয়াল। বৃহ্ত্তর পাকিস্তানে পূর্ব-পাকিস্তানিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের অন্যায় নিপীড়ন ও অসহ শাসন-শোষণ। ধর্মের লেবাস পরিয়ে পূর্ববাংলার মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার যে প্রবণতা শুরু হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে বাঙালির ইতিহাসের ঠিক আখেরি ঝাঁকুনি ছিল এই একাত্তর। অবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে এতদঞ্চলের মানুষ তাদের বিজয় সূর্যটি ছিনিয়ে আনে। আর এসবই হয়েছে জয় বাংলার পয়গম্বর, বাঙালির অনির্বাণ শিখা ও অবিনাশী পৌরুষ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও নেতৃত্বে। এ-সব যে অস্বীকার করবে, সে ঐতিহাসিকভাবে মিথ্যেবাদী।

Manual4 Ad Code

একাত্তরের মাধ্যমে এই বদ্বীপ অঞ্চলে ধর্মের মীমাংসা হয়ে গেছে। ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে যারা উর্দু ও উর্দু জনগোষ্ঠীর শাসন-ত্রাসনকে জায়েজ বানিয়েছিল, তারা ছিল মূলত ইতিহাসের নারকী তথা মহা কাজ্জাব ও মিথ্যের ফেরিঅলা। উর্দু কখনোই ইসলামে ভাষা নয়। এমনকি ফার্সি ও আরবিও নয়। তাহলে ইসলামে ভাষা কী? সে অন্য একটি প্রসঙ্গ। এ বিষয়ে অন্যতর সবিস্তারে আলোচনা করবো। এখানে সংক্ষেপে এটুকু বলতে চাই যে, ইসলামের সমূহ অপব্যাখ্যা ও রঙছটা বেলুনকে ফুটো করে দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র দেখিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের (এদেশীয় ও সে দেশীয় রাজাকার ও) তল্পিবাহকরা যে ইসলামের কথা বলে পূর্ব বাংলার মুসলিমদের বুঝ দিতো, ভয় দেখাতো, শাসন করতো, তা ছিল মূলত রাষ্ট্রনৈতিক ধাপ্পাবাজি। একাত্তর সেই ধর্মীয় ধাপ্পাবাজিতার প্রতি সর্বশেষ কুঠারাঘাত।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেন পৃথিবীকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ধর্ম মূলত শাসকশ্রেণির শোষণের হাতিয়ার। ধর্ম কখনো কল্যাণরাষ্ট্রের চালিকা-শক্তি হতে পারে না। ধর্মীয় শাসন-শোষণের সীমা-পরিসীমা ও অসীমা ও নিঃসীমা কী ও কত প্রকার, তা বাঙালির চাইতে আর কেউ ভালো করে দেখেনি! আর কেউ এত সরেজমিন উপলব্ধি করেনি! সেই বাঙালি ও বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের বুকে ছুরিচিকিৎসা চালায় বঙ্গবন্ধুর খুনিরা। ১৫ আগস্টের পর একদল অপশাসক কর্তৃক মহান মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র খোলনলচে পালটে দিয়ে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপে চুরমার করে ফেলা হয় এবং বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের কপালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ধর্মের ঠিকুজি।

Manual8 Ad Code

সেই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা, পাকিস্তানি অসুররা, ধর্মের ধ্বজাধারী ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বিরোধীরা মানবতা-বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে, দেশী-বিদেশী মির জাফরদের সহযোগিতায় দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি নানা ষড়যন্ত্র ও তালগোল পাকিয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪ ঘটিয়ে আবারও বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে আসীন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করা মাত্রই অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে, ঘৃণা ও হিংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে, তারা বাঙালির মুক্তির সনদ ও বাঙালির অহংকার, বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের মহান ইশতেহার ও অবিসংবাদিত জাগরণী কবিতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অমর বজ্রবাঁশি, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের দিবসটিসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত আরও কিছু দিবসকে বাতিল ঘোষণা করে এবং ১৫ আগস্ট তারা স্বাধীনতার আঁতুড়ঘর খ্যাত ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর পুড়িয়ে দেয়। গোটা বাংলাদেশ প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে।

জাতির এই ঘোর ক্রান্তিকালে আমরা লেখালেখি জগতের কিছু লোক ‘ক্রিয়েটিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী) গঠন করি। ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা নানা গেরিলা কায়দায় বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই রাজাকারি সরকারের তুঘলকি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছি। ১৫ আগস্ট আমরা বত্রিশ নম্বর পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে সরেজমিন সোচ্চার হয়েছি। এই জুলাই-ষড়যন্ত্রের অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি; বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাম, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও সংবিধান বিতর্ক এবং জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি প্রভৃতি বিষয়ে আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছি। ইউনূস-সরকার কর্তৃক ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিবস বাতিলের প্রতিবাদে আমরা গত ১৯ অক্টোবর ২০২৪, জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করি। এতে ক্রিয়েটিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন এর আহবায়ক কবি ও সাংবাদিক সৌমিত্র দেব ও আমি অকস্মাৎ মবের শিকার হই। সেদিন মৃত্যুরে খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং জীবনেরে দেখেছি খুবই সন্তর্পণে এবং দৈবক্রমে। সেদিনের সেই ক্ষতদগ্ধ শরীর ও মনঃপীড়া নিয়ে আমরা আজীবন পার করবো হয়তো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বাংলাদেশে।

আজ ৭ই মার্চ ২০২৫। যে মার্চ বাঙালি জাতিকে দিয়েছে মুক্তির দিগ্দিশা ও স্বাধীনতার মন্ত্রবাণী; যে বাণীর প্রতিধ্বনি ও অভয় মন্ত্রকে বুকে লয়ে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষ মানুষ মাত্রই সুদীর্ঘ ৯ মাস রক্তাক্ত সংগ্রাম করেছেন; মুক্তিযুদ্ধের বল ও সাহস হয়ে যে বাণী প্রতিটি বাঙালিকে পরিচালিত করেছে; বাঙালির হাজার বছরের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও লড়াই-সংগ্রামের সার-নির্যাস যে বাণী ও ভাষণে প্রতিফলিত; যে ভাষণ অনাগত-কালের অলৌকিক এক জাগরণী বাঁশি হয়ে গোটা পৃথিবীকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়েছে, যে ভাষণ জাতিসংঘের আর্কাইভে ঠাঁই করে নিয়েছে, সর্বোপরি যে ভাষণ, যাকে বাংলার মনস্বীরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাগরণী কবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, সে ভাষণ, সেই বজ্রধ্বনি, বাঙালি পয়গম্বরের সেই ওহির ওঙ্কারটি, সেই মোহন বাঁশিটি আজ বাংলাদেশের আকাশে বাজলো না!

কুতুব হিলালী : মুখপাত্র , ক্রিয়েটিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন

Manual4 Ad Code

 

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code