Sharing is caring!

তাপস দাশ শ্রীমঙ্গল:
গ্রীষ্মের সূর্য যখন চূড়ান্ত দীপ্তিতে প্রকৃতিকে আলোকিত করে, তখনই বাংলার জনপদ রঙে রঙে বর্ণিল হয়ে ওঠে। মৌলভীবাজারের হৃদয়ে অবস্থিত শ্রীমঙ্গল যেন সেই রঙের উৎসবের এক জীবন্ত উদাহরণ। শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটি বর্তমানে এক অপরূপ ফুলের রাজ্যে রূপ নিয়েছে। এই পথে চলতে চলতে মনে হয়, যেন প্রকৃতি তার রঙতুলিতে এক বিশাল ক্যানভাসে আঁকছে ভালোবাসার চিত্রকাব্য।
কৃষ্ণচূড়ার লাল শিখা, রাধাচূড়ার হলুদ মাধুর্য, সোনালুর ঝুলে থাকা সোনালি মালা আর জারুলের বেগুনি স্বপ্ন ছুঁয়ে যাচ্ছে পথচারীর হৃদয়। রাস্তার দুই পাশে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ফুলগাছগুলোর ডালে ডালে ফুটে থাকা রঙিন ফুলগুলোকে দেখে যেন মনে হয়, প্রকৃতি নিজেই মানুষের জন্য সাজিয়েছে এ রাস্তা- একটি জীবন্ত ফুলবাগান। গাছের সবুজ পাতার ফাঁকে উঁকি দিয়ে থাকা এই ফুলগুলো শুধু চোখেই নয়, হৃদয়ের ভেতরেও প্রশান্তির রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
প্রতিদিন শত শত মানুষ ছুটে আসছেন এই ফুলময় রাজপথে। কেউ আসছেন পরিবার নিয়ে, কেউ প্রিয়জনের হাত ধরে, আবার কেউবা একাকী প্রকৃতির নীরব ডাকে সাড়া দিয়ে। তরুণ-তরুণীদের হাতে ক্যামেরা কিংবা মুঠোফোন- তারা ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন, সেই সৌন্দর্য ধরে রাখছেন মনের খাতায় কিংবা ডিজিটাল স্মৃতিতে। কারও চোখে বিস্ময়, কারও মুখে প্রশান্তির হাসি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এই ফুলেল পথের সৌন্দর্য তাদের নিত্যদিনের হাঁটাকে করে তুলেছে আনন্দময়। সকাল কিংবা বিকেলে তারা থেমে থাকেন গাছের নিচে, উপভোগ করেন ফুলের সুবাস, আর পাখিদের কুজন যেন এক অলিখিত গান হয়ে বেজে ওঠে এই পরিবেশে।
নেদারল্যান্ডস থেকে আসা পর্যটক মিলু (Milou) চোখ জুড়ানো এই ফুলের রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, “আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, অনেক শহরের সাজানো উদ্যান দেখেছি, কিন্তু শ্রীমঙ্গলের এই রাস্তা যেন এক জাদুকরী পথ- যেখানে প্রকৃতি নিজ হাতে আঁকছে প্রেম আর প্রশান্তির ছবি। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, আমি যেন কোনো ছবির ভেতরে হেঁটে চলেছি। এটা শুধু রাস্তা নয়, এক জীবন্ত শিল্পকর্ম।”
শ্রীমঙ্গলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিরব পর্যবেক্ষক, বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার ও শিক্ষক তারিক হাসান জানান, “পাখির আলোকছায়ায় মুগ্ধ হয়ে ভোরবেলা আমি প্রায়ই ক্যামেরা হাতে বের হই, তখন এই রাস্তা থাকে নিস্তব্ধ ও ফাঁকা। কিন্তু এই ক’দিন ধরে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি- সেই নিস্তব্ধ ভোরে তরুণ-তরুণীরা আগ্রহভরে ছবি তুলতে আসে। যেন তারা প্রকৃতির সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ হারাতে চায় না। আর এক দশক আগে গোলাম মোহাম্মদ শিবলী মহোদয়ের রোপণ করা বৃক্ষরাজির যে রঙিন প্রতিফলন আমরা আজ দেখছি, তা শুধু শ্রীমঙ্গলের গর্ব নয়, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের হৃদয়েও এই দৃশ্য এক মুগ্ধতা সৃষ্টি করছে। এটি নিঃসন্দেহে এক প্রশংসনীয় উদাহরণ।”
এই রঙিন রূপের পেছনে রয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়ের একটি ভালোবাসাময় প্রচেষ্টা। ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক গোলাম মোহাম্মদ শিবলীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ১০ বছর আগে রোপণ করা হয়েছিল কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, জারুল ও সোনালুর গাছ। তার অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসনও এগিয়ে আসে, ২০২৩ সালে শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে রাস্তার দুই পাশে আরও প্রায় ৪ কিলোমিটারজুড়ে ফুলের গাছ রোপণ করা হয়। সেই গাছগুলো এখন ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে, বদলে দিচ্ছে পুরো পথের দৃশ্যপট।
প্রকৃতি ও মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা এই ফুলময় পথ এখন শুধুই একটি রাস্তা নয়- এটি এক স্বপ্নের যাত্রা। যেখানে প্রতিটি পা ফেলার সাথে সাথে আপনি ছুঁয়ে যেতে পারেন প্রকৃতির অনুপম কবিতা। আর এই কবিতা আপনাকে শোনাবে রঙ, সুগন্ধি আর সৌন্দর্যের এক অনন্ত গল্প।