আজ মঙ্গলবার, ১৮ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পবিত্র শবে বরাত মহিমান্বিত, ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় ভাগ্যের রজনী এবং আমাদের করণীয়

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫, ০৫:২৩ অপরাহ্ণ
পবিত্র শবে বরাত মহিমান্বিত, ফজিলতপূর্ণ ও বরকতময় ভাগ্যের রজনী এবং আমাদের করণীয়

Sharing is caring!

Manual7 Ad Code
মোহাম্মদ মকিস মনসুর :

“লেখার শুরুতেই মহাণ আল্লাহু রাব্বুল আলামিনের নিকট প্রার্থনা করছি সমগ্র বিশ্বের প্রতিটি মুসলমানদের এবছরের ৩০ টা রোজা, ৩০ টা সেহরি, ৩০ টা ইফতার, খতমে কোরআনের সহিত ৩০ টা তারাবির নামাজ, ইসলামের সঠিক আকিদা ও  নিয়মকানুন মেনে আদায় করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

ইসলামি তমদ্দুন তথা মুসলিম কৃষ্টিতে যেসব দিবস ও রজনী বিখ্যাত, এর মধ্যে ৫টি রাত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বিশেষ ৫টি রাত হলো: দুই ঈদের রাত্রিদ্বয়, শবে মেরাজ, শবে বরাত ও শবে কদর।

গত ১ লা ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে পবিত্র শাবান মাস গণনা শুরু হয়েছে। এই হিসাবে ১৩ ই ফেব্রুয়ারী  বৃহস্পতিবার  দিবাগত রাতে পালিত হবে লাইলাতুন নিসফ মিন শাবান বা মধ্য শাবানের রাত তথা শবে বরাত।

Manual4 Ad Code

মুসলিম সম্প্রদায়ের সৌভাগ্যের রজনী  বা ভাগ্য পরিবর্তনের রাত এই পবিত্র শবে বরাত। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মহান আল্লাহর রহমত ও নৈকট্য লাভের আশায় এই রাতে নফল নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, ওয়াজ ও মিলাদ মাহফিল, কবর জিয়ারত, ও দোয়া সহ বিভিন্ন এবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে রাতটি অতিবাহিত করেন। এই রাতে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য অশেষ রহমতের দরজা খুলে দেন।

‘শবে বরাত’ ফারসি শব্দ। শব’ অর্থ রাত বা রজনী। আর বরাত’ অর্থ ভাগ্য। দু’টো শব্দ একত্রে করলে হয় ‘ভাগ্যের রাত বা ভাগ্যের রজনী।

Manual8 Ad Code

আমাদের প্রিয় বিশ্ব নবী হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) (আঃ) এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন্ নিসফি মিন শাবান’ বা ১৫ শা’বানের রাত বলেছেন। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর রহ:।)

মর্যাদাপূর্ণ এ রাতে মহান আল্লাহ তার বান্দাদের জন্য অশেষ রহমতের দরজা খুলে দেন। এ রাতে যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা পাপী বান্দাদের ক্ষমা করেন, নিষ্কৃতি দেন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন, সেহেতু এ রাতকে লাইলাতুল বারাআত বা শবে বরাত রজনী বলা হয়। যেহেতু এ মাসটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী; তাই এ মাসকে শাবান মাস নামকরণ করা হয়। এ মাসের পূর্ণ নাম হলো ‘আশ শাবানুল মুআযযম’ অর্থ মহান শাবান মাস। (লিসানুল আরব, ইবনে মানযূর রহ:।

আলহামদুলিল্লাহ, প্রতিবছরের ন্যায় এবার ও এই ভাগ্যের রজনীরাত আমাদেরই সন্নিকটে, তাই আমাদের প্রস্তুুতি নিতে হবে, গত শুক্রবার দেশে বিদেশে প্রতিটি মসজিদের খতিব বা ঈমামগন ভয়ান ও খোতবার মাধ্যমে এই  মহিমান্বিত,দিনটির ফজিলতপূর্ণ,ও বরকতময় বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন, আমাদের বৃটেনের ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরের বড় দু’টি মসজিদ শাহজালাল মসজিদের খতিব বিশিষ্ট মাওলানা কাজি ফয়জুর রহমান সাহেব  ও  জালালিয়া মসজিদের খতিব বিশিষ্ট মাওলানা আব্দুল মুক্তাদির সাহেব সহ অন্যান্য মসজিদ গুলোতে ও মুক্তির রজনী পবিত্র লাইলাতুল বরাত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

শবে বরাতে করণীয় ও বর্জনীয় –

যা যা করা উচিত: (ক) নফল নামাজ ১. তাহিয়্যাতুল অজু, ২. দুখুলিল মাসজিদ, ৩. আউওয়াবিন, ৪. তাহাজ্জুদ, ৫. ছলাতুত তাসবিহ ৬. তাওবার নামাজ, ৭. ছলাতুল হাজাত, ৮. ছলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া।

(খ) নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। (গ) পরের দিন নফল রোজা রাখা; (ঘ) কোরআন শরিফ- যেমন: সুরা দুখান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরাসমূহ তিলাওয়াত করা; (ঙ) দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; (চ) তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; (ছ) দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা; (জ) কবর জিয়ারত করা; (ঝ) নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া করা।

যা যা করা উচিত নয়: (১) আতশবাজি ও পটকা না ফোটানো, (২) ইবাদত-বন্দেগি বাদ দিয়ে বেহুদা ঘোরাফেরা না করা, (৩) অনাকাঙ্ক্ষিত আনন্দ-উল্লাস না করা, (৪) অযথা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ না করা, (৫) অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের বিঘ্ন না ঘটানো, (৭) হালুয়া-রুটি বা খাওয়া-দাওয়ার পেছনে বেশি সময় নষ্ট না করে ইবাদত-বন্দেগির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া।

হজরত আয়শা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, “হে আয়শা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?” আমি উত্তরে বললাম, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন।’ তখন নবীজি (সা.) বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।

হজরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: নবীজি (সা.) এ রাতে মদিনার কবরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন। তিনি আরও বলেন, নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া–বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি: ৭৩৯)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে ও দিনে রোজা পালন করবে। (ইবনে মাজাহ)। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ১৪ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাত ইবাদত–বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো। কেননা, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছো কি? আমি ক্ষমা করব; কোনো রিজিক প্রার্থী আছ কি? আমি রিজিক দেব; আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করব।’ এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৪)।

এ ছাড়া প্রতি মাসের  ১৩/১৪/১৫ তারিখ আইয়ামেবিদের নফল রোজা তো আছেই, যা হজরত আদম (আ.) পালন করেছিলেন এবং আমাদের প্রিয় নবী (সা.)ও পালন করতেন, যা মূলত সুন্নাত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব (রা.) বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামেবিদের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।

এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে। সওমে দাউদি পদ্ধতিতে এক দিন পর এক দিন রোজা পালন করলেও প্রতিটি বিজোড় তারিখ রোজা হয় এবং শবে বরাতের রোজার শামিল হয়ে যায়। সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর রজব-শাবান মাসে বেশি নফল নামাজ ও নফল রোজা পালন করতেন, শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি নফল রোজা, কখনো আরও বেশি রাখতেন। এমনকি উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসে এভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। (মুসলিম)।

“শবে বরাত’ তথা শাবানের মধ্যরজনী একটি বরকতপূর্ণ রজনী, যে রাতে আল্লাহ তার বান্দাদের গোনাহ মাফ করেন। সুতরাং গোনাহর বোঝা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজকের এই রাতে মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর ক্ষমালাভের প্রত্যাশী হওয়াই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

Manual3 Ad Code

মহানবী (সা.) রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসের রাতগুলোতে বিশেষভাবে দোয়া করতেন। আমাদেরও দোয়া করা উচিৎ  হে আল্লাহ! আমার জন্য রমজান যেন মোবারক হয়, আমাকে সুস্থ রাখুন, আমি যেনো রমজানের রোজা রাখতে পারি।

Manual3 Ad Code

তাই আসুন, পবিত্র শাবান মাসের অবশিষ্ট দিনগুলোতে রমজানের পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করি আর ব্যক্তিগত ব্যস্ততাগুলোকে গুটিয়ে নিয়ে আসি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন, আমিন।

পরিশেষে একে অন্যের জন্য  আসুন দোয়া করি, দোয়াই হচ্ছে একমাত্র ভরসা, এ রাতের প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লাহ তাওবাকারীকে ক্ষমা করে দেবেন, অভাবীকে রিজিক দেবেন, বিপদগ্রস্থকে বিপদ মুক্ত করবেন।

আসুন মাহানবী রাসুল (সা:) নিদেশিত পথে এবং সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন এবং যুগে যুগে ওলামা পীর মাশাইখগণ এ রাতে ইবাদাত করে গেছেন। তাদের রেখে যাওয়া আদর্শই  অনুসরণ করে  মহাণ আল্লাহু রাব্বুল আলামিন আমাদের যথাযথভাবে শবে বরাত পালন করার তৌফিক দান করুন। এই কামনা সহ আমরা দোয়া করি, মহাণ আল্লাহু রাব্বুল আলামিন যেনো প্রতিটি মানুষের উপর খাস রহমত ও বরকত,দান সহ মৃত্যুবরনকারী সবাইকে জান্নাতবাসী করেন,,সকল অসুস্থ রুগীদের সীফা দান করেন। উচ্চারণ :“আল্লাহুম্মা, রাব্বান নাস! আযহিবিল বা’স। ওয়াশফি, আনতাশ শাফি। লা শিফাআ ইল্লা শিফা-উক,  শিফা-আ’ লা ইউগাদিরু সাকামা।”অর্থ : ‘হে মানুষের প্রতিপালক! এ রোগ দূর কর এবং আরোগ্য দান কর, তুমিই আরোগ্য দানকারী। তোমার আরোগ্য ব্যতিত কোনো আরোগ্য নেই। এমন আরোগ্য, যা বাকী রাখে না কোনো রোগ।’ (বুখারি, মিশকাত) আমিন, প্রকৃত ইসলামের আলোয় ও সঠিক আকিদায় জাগ্রত হোক মানবতা।

মোহাম্মদ মকিস মনসুর, লেখক ও সাংবাদিক, সাবেক সেক্রেটারি, কার্ডিফ শাহজালাল মস্ক এন্ড ইসলামিক কালচারাল সেন্টার, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনজুমানে আল- ইসলাহ ওয়েলস ডিভিশন ইউকে,চেয়ারম্যান, ইউকে বিডি টিভি, আল-মনসুর মিডিয়া, কচুয়া হাউস,কার্ডিফ ইন ইউকে, ১২ ই ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ইংরেজি।

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code