“তুমি চেয়েছো আমি মরে যাই, আর তুমি জগৎ সংসারে ভালো থাকো। আমি এখন পোকা মারার বিষ খাবো। আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী।”—এমনই হাহাকারে ভরা একটি ডায়েরি রেখে কীটনাশকপানে আত্মহত্যা করেছেন টাঙ্গাইলের স্কুলশিক্ষিকা লাকী আখতার।
২৬ বছর বয়সী এই তরুণী মধুপুর উপজেলার কেউটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। ইডেন কলেজ থেকে মাস্টার্স শেষে ২০২৩ সালে শিক্ষকতায় যোগ দেন তিনি।
লাকীর বাবা আব্দুল লতিফ জানান, ২০২৪ সালে বিটিপিটিতে প্রশিক্ষণের সময় সহকর্মী ইবনে মাসুদের সঙ্গে তার মেয়ের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাসুদ লাকীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে লাকী বিয়ের চাপ দিলে মাসুদ জানান, তিনি বিবাহিত এবং তার স্ত্রী-সন্তান রয়েছে।
ভবিষ্যতের সব আশা-ভরসা হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন লাকী। এক পর্যায়ে ২৪ জুন রাতে নিজ রুমে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ জুন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর আগে লাকী পাঁচ পাতার একটি ডায়েরিতে লেখেন, পৃথিবীতে মৃত্যৃ যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
আজ বিকেল পর্যন্তও বেঁচে থাকার ইচ্ছা মনের গভীর কোণে উঁকি দিয়েছে। কিন্তু তোমার অবজ্ঞার কারণে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম। হ্যাঁ তোমাকে বলছি- সুপ্রিয়, আস্থাভাজন, বন্ধু প্রীতম ইবনে মাসুদ স্যার।’
বিগত দুই বছর তুমি আমার মন পাওয়ার চেষ্টা করেছো। ফুঁসলিয়ে আমার সর্বনাশ করেছো। তুমি কীভাবে আমাকে ফাঁদ পেতে ধরেছো সেটা আল্লাহ তো দেখেছে।
… যখন আমি তোমার সকল কথা বিশ্বাস করলাম, ভরসা করলাম, ভালোবাসলাম, তখন তুমি আমার হাত ছেড়ে দিলে। তুমি আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ভোগ করলে। আমাকেই কেন টার্গেট করে সমাজের কাছে আমাকে অপরাধী করলে।
তুমি আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে ভোগ করলে। তুমি জানতে তোমার বাসা থেকে বের হওয়ার পর আমি কোন দুর্ঘটনা নিশ্চিত ঘটাবো। তবু আটকালে না। তুমি চাচ্ছো আমি মরে যাই। আর তুমি জগৎ সংসারে ভালো থাকো।
আমি এখন পোকা মারার বিষ খাবো। আসার সময় কিনে এনেছি। আমার সঙ্গে যা করলে দুনিয়ার কোনো মানুষের সঙ্গে করো না প্লিজ। আমার মৃত্যুর জন্য তুমি দায়ী।”
মৃত লাকী টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার কুড়ালিয়া গ্রামের লতিফ মিয়ার বড় মেয়ে। লাকীর বাবা আব্দুল লতিফ জানান, লাকীকে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে শিক্ষক ইবনে মাসুদ।
পরিবারের আশা ছিল মেয়ে চাকরি করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাবে। সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। ভালো ঘর দেখে তার বিয়ে দেবো। সব আশা চুরমার হয়ে গেছে। আমি লম্পট মাসুদের ফাঁসি চাই।’
লাকীর মা কোহিনূর বেগম জানান, লাকী ছিল চাপা স্বভাবের মেয়ে। প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের কারো সাথে শেয়ার করেনি। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট হয়তো চেপে রেখেছিল মেয়েটা। সেই নিদারুন কষ্টের চাপে হতাশায় পড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তার মেয়ে।
তিনি আরও জানান, ২৪ জুন রাতে নিজ কক্ষে কীটনাশক পান করে ছটফট করতে থাকে লাকী। পরে মধুপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ময়মনসিংহ মেডিক্যালে নেওয়া হলে ২৭ জুন মে মারা যায়।
তার ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরিতে প্রেমিক ইবনে মাসুদের প্রতারণা ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা লেখা রয়েছে। মাসুদের শাস্তি দাবি করেন লাকীর মা।
কেউটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হাসিনা খাতুন জানান, লাকী ম্যাডাম খুব চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তিনি এমন করুণ ঘটনার সম্মুখীন হবেন তা কল্পনাই করা যায় না।
এদিকে প্রতারণা এবং আত্মহত্যার প্ররোচনার দায়ে গত ২৮ জুন মধুপুর থানায় লাকীর পিতা আব্দুল লতিফ মধুপুর থানায় মামলা করেন। একমাত্র আসামি শিক্ষক ইবনে মাসুদ। শিক্ষক মাসুদকে গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে গত মঙ্গলবার কেউটাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
গপিনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ৫ দিন ধরে স্কুলে অনুপস্থিত ইবনে মাসুদ। সহকর্মীরা জানান, লাকী ম্যাডামের আত্মহত্যার খবর শুনে মাসুদ গাঁ-ঢাকা দিয়েছেন।
এদিকে লাকীর আত্মহত্যার ঘটনা ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপে মাসুদের ফাঁসির দাবি করে অনেকে পোস্ট দেন।
মধুপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতি মাসুদের ফাঁসির দাবিতে বুধবারও (২ জুলাই) উপজেলা পরিষদ চত্বরে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
মধুপুর থানার ওসি ইমরানুল কবীর ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, প্রেমের সম্পর্ক থেকে ওই শিক্ষিকা এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।
কিন্তু প্রেমিক মাসুদ বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয় লাকী। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে ইবনে মাসুদকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।