আজ রবিবার, ৭ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মধু পূর্ণিমা : বন্যপ্রাণীর দান ও সেবায় মানবতার শিক্ষা 

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫, ১২:০০ অপরাহ্ণ
মধু পূর্ণিমা : বন্যপ্রাণীর দান ও সেবায় মানবতার শিক্ষা 

Sharing is caring!

লায়ন উজ্জল কান্তি বড়ুয়া,
মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধ ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যময় একটি দিবস। এটি ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উৎযাপিত হয় বলে এটিকে ভাদ্র পূর্ণিমাও বলা হয়। তবে বানর কর্তৃক মধুদানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে এই দিনটি মধু পূর্ণিমা নামে খ্যাত।
এছাড়া বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুষ্ঠান সাধারণত পূর্ণিমা তিথিতেই হয়ে থাকে। কারণ, তথাগত বুদ্ধের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি পূর্ণিমাতেই সংঘটিত হয়েছিল। মধু পূর্ণিমার বিশেষ দিক হল বানর এবং হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধকে সেবা ও পূজা করার ঘটনা। কেননা বনের পশু কর্তৃক বুদ্ধকে পূজা ও সেবা দান একটি বিরল দৃষ্টান্ত এবং মানব জীবনে অনুকরণীয় তথা শিক্ষণীয় উদাহরণ বৈ কি!
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ অব্দে তথাগত বুদ্ধ গৌতম বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশস্থ কৌশাম্বী নামে এক সমৃদ্ধশালী নগরে তাঁর জীবনের নবম বর্ষাবাস অতিবাহিত করেন। তখন সেখানে একটি বিহারে দুইজন ভিক্ষুর মধ্যে শৌচাগারে জল রাখা সম্পর্কিত বিনয় বিধান নিয়ে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়। মহামতি বুদ্ধ ভিক্ষুদের কলহ নিবারণার্থে ‘লটুকিকা’ জাতক, ‘বত্তক’ জাতক দেশনা এবং রাজা দীঘীতির উপদেশে যেভাবে দু-দেশের রাজার মধ্যে মিত্রতা স্থাপন হয়েছিল সে বিষয়সহ অস্ত্রশস্ত্র ধারী রাজাদের মধ্যে প্রচন্ড শত্রুতা হতে মিলন হতে পারে তবে এমন সু-আখ্যাত ধর্ম বিনয়ে প্রব্রজ্যিত হয়েও তোমরা কেন বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত?
তখন বুদ্ধ কৌশাম্বী ত্যাগ করে পারল্যেয় নামক বনে প্রবেশ করেন। তখন বর্ষাবাসের সময়কালীন হওয়ায় সেই বনেই বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করেছিলেন। সেটি ছিল বুদ্ধের জীবনে ১০ম বর্ষাবাস।
সে সময়ে বুদ্ধের মৈত্রী প্রভাবে  পারল্যেয় বনের হস্তীরাজ বুদ্ধের সেবা-যত্নে লেগে গেল। হস্তীরাজ প্রথমেই ভদ্রশাল বৃক্ষের পাদদেশে পায়ের দ্বারা আঘাত করে বুদ্ধের জন্য আসন করে দিল এবং শুঁড় দ্বারা শাখা নিয়ে বৃক্ষতল পরিষ্কার করে দিল। এতদৃশ্য দর্শনে বুদ্ধ বললেন, “হস্তীরাজ, তুমি একাকী অবস্থান করছ, আমিও একাকী অবস্থান করছি।” এখানে উল্লেখ্য যে হস্তীরাজ বয়োবৃদ্ধ হওয়াতে অন্যান্য হস্তীপাল তাকে আর মান্য করছিল না। সে সময় হতে হস্তীরাজ তথাগত বুদ্ধকে বিবিধ ভাবে সেবা পরিচর্যা করত। বুদ্ধ ভিক্ষান্ন সংগ্রহে যাবার সময় পাত্র নিয়ে আগু বাড়িয়ে দিত, আগমন কালেও আগু বাড়িয়ে নিয়ে আসত। বুদ্ধের প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থা করে দিত, বন হতে বিবিধ ফলমূল সংগ্রহ করে দান দিত সশ্রদ্ধ চিত্তে।
এভাবে বুদ্ধ এবং হস্তীরাজ যখন অবস্থান করছিল সে সময় এক বানর হস্তী কর্তৃক বুদ্ধ পূজা অবলোকন করল। বানর চিন্তা করল, হস্তীও পশু আমিও পশু, হস্তী যদি বুদ্ধের সেবা করতে পারে, দান করতে পারে তবে আমি কেন পারব না? হস্তীর দান যেহেতু বুদ্ধ গ্রহণ করেন, অনুমোদন করেন, ভোজন করেন। আমার দানও নিশ্চয় মহাপুরুষ বুদ্ধ গ্রহণ করবেন, অনুমোদন করবেন, ভোজন করবেন। অতঃপর বানর বুদ্ধকে কি দান করবে তা ভেবে বনে বিচরণ পূর্বক কোন একদিন কোন এক বৃক্ষ দন্ডে মধু মক্ষিকা বিহীন এক মৌচাক দেখতে পেল। বানর মনে মনে ভাবল, এই বনের মধ্যে এরচেয়ে উৎকৃষ্ট দান আর কি হতে পারে।
বানর অত্যন্ত আহ্লাদিত চিত্তে সেই দন্ডটি ভেংগে দন্ডসমেত মৌচাকটি তথাগতের নিকট নিয়ে আসল এবং একটি কদলীপত্র ছিঁড়ে মৌচাকটি দন্ডসমেত তথাগতকে প্রদান করলে তথাগত তা গ্রহণ করলেন। বুদ্ধ তা পরিভোগ করেন কিনা দেখার নিমিত্তে বানর সে স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকল। বানর দেখল বুদ্ধ তা পরিভোগ করছেন না, শুধু হাতে নিয়েই বসে আছেন। এর কারণ কি তা জানার জন্য বানর মৌচাক দন্ডের প্রান্তভাগ নিয়ে মৌচাকটি উল্টালে দেখা গেল সেখানে কিছু মৌমাছির ডিম। বানর অত্যন্ত যত্নসহকারে মৌচাক থেকে মৌমাছির ডিম ছাড়িয়ে নিলে অনিন্দ্য শ্রদ্ধার সেই দান বুদ্ধ সস্নেহে গ্রহণ করলেন এবং সেখান থেকে মধু পান করলেন। মধুপান করতে দেখে বানর খুশিতে, আনন্দে আতহারা হয়ে এক বৃক্ষশাখা হতে অন্য বৃক্ষশাখায় লাফাতে লাগল। হঠাৎ অসবধানতাবসতঃ বৃক্ষের শাখা ভেঙ্গে বানর পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সেখানেই মৃত্যুবরণ করে।
বুদ্ধকে মধুদান এবং বুদ্ধের প্রতি প্রসন্নচিত্ত হয়ে সেই বানর দেহত্যাগ করার ফলে পরজন্মে সে তাবতিংস স্বর্গে জন্ম নিয়ে ত্রিশ যোজন বিস্তৃত কনকমণ্ডিত দেববিমান ও সহস্র অপ্সরা লাভ করল। সেদিন ছিল পবিত্র মধু পূর্ণিমা তিথি। এই দিকে ভিক্ষুরা নিজেদের ভূল বুঝতে পেরে বর্ষাবাস শেষে তাঁরা বুদ্ধের সেবক ধর্মভান্ডারিক আনন্দকে নিয়ে বুদ্ধকে ফিরিয়ে নিয়ে যান।বুদ্ধ চলে যাবার পর হস্তীরাজও করুণা সিন্ধু বুদ্ধের বিরহ ব্যথা সইতে না পেরে হৃৎপিন্ড বিদীর্ণ হয়ে মারা গিয়েছিল। কিন্ত শাস্তার প্রতি চিত্ত প্রসন্নতার দরুণ হস্তীরাজও তাবতিংস স্বর্গে ত্রিশ যোজন বিস্তৃত সহস্র দেবকন্যার মধ্যে উৎপন্ন হয়েছিল তার নাম হয়েছিল পারল্যেয় দেব পুত্র। বুদ্ধ পরশে এসে বুদ্ধ পূজা করে তির্যক যোনিজাত হস্তীরাজ ও বানর লাভ করেছিল উর্ধ্বগতি।
পারল্যেয় বনে হস্তিরাজ কর্তৃক ভগবান বুদ্ধের সেবাপ্রাপ্তি ও বানরের মধুদানের কারণে এ দিনটি বৌদ্ধদের কাছে স্মরণীয় ও আনন্দ-উৎসবমুখর পুণ্যময় একটি দিন। এ উপলক্ষে বৌদ্ধ সম্প্রদায় বুদ্ধ পূজা, সীবলী পূজা, শীল গ্রহণ, সংঘদান, মধু ও ভেষজ দান, প্রদীপ প্রজ্বলন, ভিক্ষু সংঘকে পিণ্ডদানসহ নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে থাকে। মধু পূর্ণিমাকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধদের দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। যেগুলো অতীব কুশলময় কর্ম। মধু পূর্ণিমার এই পবিত্র দিনে সবার জীবনে দান-শীল-ভাবনায় উৎপন্ন হোক সদ্ধর্মের বাতাবরণ। সদ্ধর্মের আলো ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র, দূর হোক সকল অকুশল, জগতের সকল প্রাণী সুখি হোক, দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করুক।
লেখক পরিচিতি : কলাম লেখক ও সংগঠক।