আজ শনিবার, ২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের খাবারে অনিয়ম করে লাখ লাখ টাকা আত্নসাৎ

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৫, ০৪:১৬ অপরাহ্ণ
রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীদের খাবারে অনিয়ম করে লাখ লাখ টাকা আত্নসাৎ

Sharing is caring!

মো: জাফর ইকবাল:

মৌলভীবাজারের রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে লাখ লাখ টাকা আত্নসাতের অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এক শ্রেনীর অসাধু কর্মকর্তা কর্মচরীর সহযোগিতায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি এধরনের অনিয়ম করে আসছে। নির্ধারিত পরিমানের চাইতে কম এবং নিম্নমানের খাবার দেয়ার অভিযোগ করেছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা।

হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষের জন্য একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হলেও বর্তমানে ১৯ শয্যা চলছে। প্রয়োজনীয় সেবা পাচ্ছেন না পাওয়ার পাশা পাশি রোগীদের খাদ্য নিয়ে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। ১৯৮৬ সালে তৎকালীন সরকার রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং ওই সময় ৩১ শয্যা বিশিষ্ট অন্তঃবিভাগ ও বহিঃবিভাগ ভবন করা হয়।


উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন জনপ্রতি রোগীর জন্য সরকারিভাবে এত বড় বাজেট থাকার পরও নাস্তাসহ দুই বেলার খাবার ১৭৫( ভ্যাট ট্রেক্স সহ) টাকা বরাদ্দ রয়েছে। প্রতি বছরের খাদ্য তালিকায় বরাদ্ধ থাকে চাউল পোলাও( উন্নত) ৫০ কেজি, চাউল আতব( উন্নত) ৬ হাজার কেজি, রান্নার জন্য মুসুরের ডাল ১১ শতাধিক কেজি, নাস্তার জন্য পাউরুটি বেঙ্গল ১৬ শতাধিক, চাপা কলা. ৭৫ গ্রাম ওজনের সাড়ে ৫ হাজারের অধিক, সোয়াবিন তৈল ১১ শত লিটারের উপরে। মশলা দারচিনি ২৫ কেজি, গোলমরিচ ১৫ কেজি, লবঙ্গ ৫ কেজি, এলাচি ৩ কেজি, হলুদ ১১২ কিজি, মরিচের গুড়া ১১২ কেজি, ধনিয়া ৬৫ কেজি, জিরা ৫০ কেজি, রসুন ৫৫৮ কেজি, আদা ১১২ কেজি। রোগীদের জন্য খাসির মাংস ৩৫ কেজি, দেশী মুরগীর মাংস , ৪৯০ কেজি, ব্রয়রারের মুরগী ৬ শত কেজি, ডিম সাড়ে ১১ হাজার, হাঁসের ডিম সাড়ে ১১ হাজার, রুই মাছ ১২ শত কেজি, কাতলা মাছ ১২ শত কেজি, ঘাস কার্প সব মাছ ১২ শত কেজি সব মাছ মাথা ও নাড়ি ভুরি ছাড়া ঠিকাদার সরবরাহ করতে । এছাড়া সব ধরনের তাজা সবজি ফুল কপি ১১১৬ কেজি, চাল কুমড়া ১১১৬ কেজি, পেপে ১১১৬ কেজি, লাউ ১১১৬ কেজি, মিষ্টি কুমড়া ১১১৬ কেজি, গোল আলু ৩.৫০ সে: মি: নীচে নয় ১১১৬ কেজি, কাচা মরিচ ২৬০ কেজি, টমেটো ১১১৬ কেজি, লেবু ২৮০ কেজি, শসা ২৮০ কেজি। প্রতিবছরের বরাদ্ধ থাকলেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার স্ব্যস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা কর্মচারীর সহযোগীতায় নিন্ম মানের ও ওজনে এত কম দেয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারেন না। গত ২৪-২৫ ইং অর্থ বছরে কোন ঠিকাদার না থাকায় মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন নিজ দায়ীত্বে রাজনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়ীত্ব চালান। রোগীদের অভিযোগ ঔই সময় থেকে খাদ্যের অনিয়মের সুত্রপাত।

রোগীরা জানান, আমরা সাত দিন ধরে ভর্তি। সকালে একটা ছোট একটি কলা, একটা ডিম আর দুই পিস লোপ দেয়। যে পানির মতো,কিসের মসলা,কিসের কী তরকারি দেয়।আমরা গরিব মানুষ তবুও তো আমরা এমন তরকারি খাই না। দুপুর বেলা বড় চাউলের ভাত,দুই টুকরা আলু,আর এক পিস মাছ অথবা এক টুকরু মাংস।

রোগী করিম বলেন, এই হাসপাতালের যে অবস্থা খুবই খারাপ। রোগী যদি আসে ভালো হওয়ার জন্য, কিন্তু রোগী আরও বেশি রোগী হয়ে যাবে। এই বেডের অবস্থা দেখেন। মানুষ তো ঘুৃমাবে না, কিন্তু রোগী ঘুমাচ্ছে। লিস্টে খাদ্যের পরিমাণ লেখা আছে, কী ভাবে রোগীরা খাবে। মোটা চালের ভাত। এসব গরুও খাবে না। এই সব কিছু তারা হরিরলুট করছে।
ভর্তি থাকা রোগী আখতারুল বেগম বলেন, দুপুরে যে ভাত দেওয়া হয়,সেই ভাত আবার রাতে দেওয়া হয়। আর রাতের ভাত আমাদেরকে দেওয়া হয় সকালে। অনেক সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে জেনারেটার বন্ধ থাকে। জেনারেটারের তেল আত্মসাৎ করা হয়।

রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে বাবুর্চি রুকিয়া বলেন, সিভিল সার্জেন যা বলেছেন তা সম্পুর্ন মিথ্যা। এগুলো সত্যি নয়। টিকাদারে যা খাবার দেয়। আমি শুধু রান্না করে দেই। আপনি যতটুকু আমাকে দিবেন, আমি ত ততটুকু রান্না করে রোগীকে দিব। আগে তৈরি করতাম ২০ জন ২৫ জনের। আর এখন প্রতিদিন ৩১ জনের রান্না হয়।

রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে বাবুরচি রুকিয়া বলেন, ঠিকাদারে যা খাবার দেয় এসব টিসির মাধ্যমে। সিভিল সার্জেন্টে যে বক্তব্য দিছে, তা সব মিথ্যা কথা। সব কিছু ঠিকাদারে দ্বায়িত্বে নিয়ে নিয়েছে। উনি যেভাবে কেটে দেন সেটাই। আমি শুধু রান্না করে দেই। আগে তৈরি করতাম ২০ জন ২৫ জন ১৫ জন। আর এখন প্রতি দিন ৩১ জনের রান্না হয়।

রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে সিনিয়র স্টাফ নার্স শিউলি বলেন, এখানে বেড আছে ১৫ কি ১৬ টা। ১৬ টা বেডের মাঝে, প্রায়ই সব ফিলাপ থাকে। এখনও আছে। সকালে ছুটি দেওয়ার পর, এখন ১৩/১৪ টা মতো আছে। ঔষধ যেগুলো আমাদের কাছে আছে। সেগুলাই দেওয়া হয়।

রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে অফিস সহায়কের লিপি বেগম জানান, নিম্ন মানে খাবার যদি হয়ে থাকে। জনসাধারণে যদি খেয়ে না থাকেন। তাহলে এটার জবাবদিহিতা জন্য কর্তৃপক্ষ অবশ্যই আছে। তাদের সাথে কথা বলতে পারেন। জনসাধারণে যেটা বলবে, হয় তো অনেক সময় দেখার ভুল হয়তে পারে। অনেক সময় ত্রুটির কারণে বলতে পারে। রান্না ঘর বন্ধ রাথার বিষয় বলেন, কুকার সে বিকাল বেলা আসবে তখন খুলবে।

আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. অসীম কুমার বিশ্বাস বলেন, আমাদের কাগজে কলমে ৩১ বেড। কিন্তু ৩১ বেড নাই । বর্তমানে ১৯ বেড আছে। অসীম বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিন রোগী ভর্তি বিষয় ততটা পরিপূর্ণ থাকে এবং ২/৩ জন কম ও হতে পারে। আমাদের ১৯ টি বেড হয়েছে এবং, ১৯ টি বেড পরিপূর্ণ থাকে। মাঝে মাঝে ২/৩ টি কম থাকে। যত জন রোগী থাকে ততজনের রান্না করা হয়। এই তথ্য টি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি হচ্ছে সম্পুর্ন ভুল তথ্য। এই তথ্য জেনে আপনার কি লাভ।
ঠিকাদারের বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন তথ্য দিতে নারাজ।

ফলে ঠিকাদারের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
রাজনগরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে উপ-সহকারী মেডিকেল অফিসার সুমিতা দে বলেন, আমার স্যারের অনুমতি ছাড়া তো আমি কিছু বলতে পারব না।

আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. অসীম কুমার বিশ্বাস বলেন, আমাদের বহি: বিভাগে তো আসলে গুরুত্বপূর্ণ যেসব ঔষধ লাগে সে সব তো আমরা দিচ্ছি। ঔষধ সংকট নাই। কিছু কিছু রোগী ঔষধ সংকট বলবেই। কারণ রোগী যদি চায় ব্যবস্থা পত্রের সব ঔষধ উনাদের দেই। তাহলে এটা তো সম্ভব নায়। আমাদের মাঝে মাঝে দেরি হয় ৫/৬ মিনিট । সব সময় না। আমাদের কাগজে কলমে ৩১ বেড। কিন্তু ৩১ বেড নাই। বর্তমানে ১৯ বেড আছে।

রোগীদের খাবারে অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলার সিভিল সার্জন ডা. মোঃ মামুনুর রহমান বলেন, রোগীদের খাবার বিষয়ে আমার কাছে অনেক অভিযোগ এসেছে এর সত্যতা ও পাওয়া গেছে। খাবারের টিকাদারকে বলা হয়েছে আপনার নামে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ করেছেন রোগীরা। কয়েকদিন আগে আমি রাজনগর গিয়েছিলাম এবং রান্না ঘরের গিয়েছিলাম। রান্না ঘরে গিয়ে দেখি মাছের টুকরো ছোট্ট। তখন আমি টিকাদারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে অভিযোগ করে বলেন, রান্না ঘরের বাবুর্চি। আমি সব কিছু কিনে দেই বাবুর্চি মহিলা কে। তার পরিবারের লোকজনকে খাওয়ার জন্য কিছু অংশ রেখে দেয়। বাকি অংশ রোগীদের মধ্যে বিতরণের সময় রোগীদের মধ্যে কম পড়ে। আমি এই জেলায় অক্টোবরে এসেছি। টেন্ডার গতবছর হয়নি। এবার আমি হাতে নিয়েছি। আমি যে পরিকল্পনা নিয়েছি একটা স্ট্যান্ডার টেন্ডার যাতে স্ট্যান্ডার লোক আসতে পারে। এখানে আলতোপালতো লোক রয়েছে। এরা ঝামেলা করে। স্টেন্ডার রক্ষা করার জন্য আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।