বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় চালানো ভয়াবহ হামলায় ১৫ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার এক বছর পার হলেও মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং বিস্ফোরক পরীক্ষার রিপোর্ট এখনও না আসায় তদন্ত চূড়ান্ত করা যাচ্ছে না।
২০২৪ সালের ৪ আগস্টের সেই ঘটনায় মামলা হয় ঘটনার ২১ দিন পর, ২৭ আগস্ট। মামলাটি দায়ের করেন এনায়েতপুর থানার এসআই আব্দুল মালেক। তিনি এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ চার নেতার নাম উল্লেখ করে আরও পাঁচ থেকে ছয় হাজার অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করেন।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, ওই দিন দুপুর ১২টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা এনায়েতপুর থানার সামনে অবস্থান নেয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেও ওসি আব্দুর রাজ্জাক হ্যান্ড মাইকে বক্তব্য দিয়ে ছাত্র-জনতাকে শান্ত থাকতে বলেন এবং তাদের থানার এলাকা ত্যাগে আহ্বান জানান।
ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণভাবে সরে গেলেও কিছুক্ষণ পর আওয়ামী লীগ নেতা আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চুর নেতৃত্বে দেশীয় অস্ত্রসহ পাঁচ-ছয় হাজার ব্যক্তি থানা ঘিরে ফেলে এবং হামলা চালায়।
আত্মরক্ষায় পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরে আসামিরা পুলিশের কোয়ার্টার ও ওসির বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আতঙ্কিত পুলিশ সদস্যরা যখন আশ্রয়ের চেষ্টা করছিলেন, তখন আসামিরা থানায় প্রবেশ করে সাত পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। এরপর থানা ভবনের অস্ত্রাগার ভেঙে সরকারি ও ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলি লুট করে।
এসব অস্ত্র দিয়ে তারা থানার ভেতর ও বাইরে থাকা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।
ওসি আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেক পুলিশ সদস্য কাছাকাছি বাবু মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু হামলাকারীরা সেখানেও পৌঁছে কয়েকজনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে। নারী কনস্টেবল রেহেনা পারভীনকেও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় বলে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে।
ঘটনার পর বিকালে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে হতাহতদের উদ্ধার করে। নিহত পুলিশ সদস্যরা হলেন: ওসি আব্দুর রাজ্জাক, এসআই রইস উদ্দিন খান, তহছেনুজ্জামান, প্রনবেশ কুমার বিশ্বাস, নাজমুল হোসাইন, আনিসুর রহমান মোল্লা, এএসআই ওবায়দুর রহমান, কনস্টেবল আব্দুস সালেক, হাফিজুর ইসলাম, রবিউল আলম শাহ, হুমায়ন কবির, আরিফুল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলাম, শাহিন উদ্দিন ও হানিফ আলী।
মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা এসআই ফরিদ উদ্দিন জানান, প্রায় দুই মাস ধরে তিনি মামলার তদন্ত করছেন। এর আগে দুইজন কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেন। ময়নাতদন্ত এবং সিআইডির রিপোর্ট ছাড়া তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
এ ঘটনায় শুধুমাত্র এই একটি নয়, জেলায় মোট নয়টি মামলা হয়। সিরাজগঞ্জ সদর থানায় চারটি, এনায়েতপুর থানায় তিনটি এবং উল্লাপাড়া থানায় একটি করে মামলা করা হয়। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ৬৭২ জন এবং অজ্ঞাতপরিচয় আসামি পাঁচ থেকে ছয় হাজার।
এছাড়া, গত এক বছরে রাজনৈতিক ঘটনার জেরে জেলার বিভিন্ন থানায় আরও ২০টির বেশি মামলা হয়। এসব মামলায় সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাস, সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী, তানভীর ইমাম, চয়ন ইসলাম, আব্দুল আজিজ, জেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান শামীম তালুকদার লাবু, উল্লাপাড়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান সেলিনা মির্জা মুক্তি ও সিরাজগঞ্জ বারের সাবেক পিপি আব্দুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অন্তত ১৬৩ জন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।