আজ রবিবার, ১লা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাণিজ্য বাধা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় চাপে বাংলাদেশের পোশাক খাত

editor
প্রকাশিত মে ৩০, ২০২৫, ০৯:০২ পূর্বাহ্ণ
বাণিজ্য বাধা ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতায় চাপে বাংলাদেশের পোশাক খাত

Oplus_16908288

Sharing is caring!

সিনিয়র প্রতিবেদকঃ
বহির্বিশ্বে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও নতুন করে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্প।
গত এক বছরে এ খাত ১০ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখালেও, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে খাতটি।
তৈরি পোশাক খাত দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ জোগান দেয় এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করে। কিন্তু ১৭ মে ভারত সীমান্তবর্তী স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্যের আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ভারতের এই পদক্ষেপ আসে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একই স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায়। এতে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের প্রায় ৪২ শতাংশ রপ্তানি প্রভাবিত হচ্ছে, ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য সমুদ্রপথ ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যে ১০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে, যা বাড়তে বাড়তে ৩৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালত ‘অন্যায্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, তবুও তা এখনো বহাল রয়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, দেশীয় ও বৈশ্বিক সমস্যার সমন্বয়ে খাতটি চরম চাপের মুখে রয়েছে। নীতিগত সহায়তার অভাব, গ্যাস ও জ্বালানির সংকট, উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি, উচ্চ সুদের হার এবং বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণে বহু টেক্সটাইল মিলে উৎপাদন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মবিরতিসহ ধারাবাহিক ধর্মঘটে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের অবনতির পটভূমিতে ভারতের বাণিজ্যিক পদক্ষেপ এসেছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন বেড়েছে।
এর প্রভাবে ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাও স্থগিত হয়েছে, যা বাংলাদেশি পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক হাসান বলেন, ‘ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধের ফলে অনেক দেশে পণ্য পাঠাতে সময় ও খরচ দুটোই বেড়ে গেছে।’
 বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে ভারত হয়ে ৩৬টি দেশে বাংলাদেশ ৩৪ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন পোশাক রপ্তানি করেছে, যার মূল্য ৪৬২.৩৪ মিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলে নিয়মিত প্রতিবাদ ও ধর্মঘট চলছে। সরকারি কর্মচারী ও পোশাক শ্রমিকদের দাবিকে কেন্দ্র করে রাস্তায় নেমেছে হাজারো মানুষ। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সরকার বাণিজ্যনীতি নির্ধারণে মনোযোগ দিতে পারছে না বলে অভিযোগ মোহাম্মদ হাতেমের।
এই অস্থিরতার মধ্যে জুলাই ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত পোশাক রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে। মোট রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩২.৬৪ বিলিয়ন ডলারে, যা খাতটির সক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়। হাতেম বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। তারা উদ্ভাবনী, দক্ষ এবং ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।’
তবে বড় কারখানাগুলো টিকে থাকলেও ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফারুক হাসান বলেন, ‘ছোট কারখানাগুলো রক্ষা না করলে ভবিষ্যতে বড় সংকট তৈরি হবে।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা দীর্ঘস্থায়ী না-ও হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী নেতারা ২০২৬ সালের নভেম্বরে নির্ধারিত বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ পেছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশ বহু বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবে।
তবে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তিন বছর, চীন দুই বছর এবং কানাডা ২০৩৪ সাল পর্যন্ত এই শুল্ক সুবিধা অব্যাহত রাখবে। সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে।’