আজ বৃহস্পতিবার, ২৩শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৯ই মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাইবান্ধার পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ ছাড়া আবেদন গ্রহণ না করার অভিযোগ কর্মচারির বিরুদ্ধে

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪, ০১:৩২ অপরাহ্ণ
গাইবান্ধার পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ ছাড়া আবেদন গ্রহণ না করার অভিযোগ কর্মচারির বিরুদ্ধে

Sharing is caring!

রাজু সরকার গাইবান্ধা প্রতিনিধি:
গাইবান্ধা আঞ্চলিক  পাসপোর্ট অফিসে  আবেদন করতে এলে বেশির ভাগ সঠিক আবেদনের বিভিন্ন ত্রুটি দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছে বিশান চন্দ্র রায় নামের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে।শুধু তিনিই নন, এই অফিসের বেশকিছু  কর্মচারীদের সাথে আগেই জোগসাজোশও থাকে দালাল-চক্রের বলছেন ভুক্তভোগি ও স্থানীয়।কোন আবেদনটি গ্রহণ হবে তার জন্য আগে থেকে আবেদন কাগজপত্রে নির্দিষ্ট চিহ্নও যৌথভাবে ব্যবহার করেন দালাল চক্র ও  অফিস কর্মচারীরা।তবে হয়রানি মুক্ত সেবা চাচ্ছেন ভুক্তভোগী ও গাইবান্ধাবাসী।
জানা যায়, গাইবান্ধা  আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট  করতে এলেই ফিঙ্গার প্রিন্ট এর নামে ঘুষ না দিলেই ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ সেবাগ্রহীতাদের।সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ,সঠিক আবেদন নিয়ে গেলে কম্পিউটার ডাটা এন্ট্রি বিশান চন্দ্র রায় ফিঙ্গার প্রিন্টের জন্য বাড়তি ১৫ শত টাকা করে ঘুষ দাবি করেন।এই  টাকা না দিলে ১০ – ১৫ দিন হয়রানি করেন তিনি।
অপরদিকে যাদের কাছে বিশান টাকা চান না তারা আবার শরণাপন্ন হয় অফিসের ভিতরে থাকা আনসার বাহিনীর সদস্য কিংবা অফিসের বাহিরে থাকা কম্পিউটার দোকানের দালালদের।এরকমই চিত্র  দেখা যায় পাসপোর্ট অফিসের বাহিরে ও ভিতরে।
এতে অন্য কোন উপায় না পেয়ে দালালদের শরণাপন্ন হয়ে  পাঁচ বছর মেয়াদে সাধারণ পর্যায়ে পাসপোর্ট  যেখানে খরচ হয়  ৪ হাজার ২৫ টাকা তার পরিবর্তে ৭ হাজার ও দশ বছর মেয়াদে   ৫ হাজার ৭ শত ৫০ টাকা  পরিবর্তে ৯ হাজার টাকা খরচেরও কথা বলছেন সেবাগ্রহীতারা।অপরদিকে জরুরী পর্যায়ে পাঁচ বছর মেয়াদে ৬ হাজার ৩ শত ২৫ টাকার পরিবরর্তে ৯ হাজার ও দশ বছরের ৮ হাজার ৫০ টাকার পরিবর্তে ১০ হাজার টাকা নেয় দালালরা। এসব টাকা না দিলে বেশিরভাগই ভোগান্তির  শিকার হচ্ছেন এই দুই  পাসপোর্ট  সেবাগ্রহীতারা। এতে করে তাদের প্রতি পাসপোর্ট করতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে প্রায় দেড় থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত।প্রতিদিন এখানে দেড় শতাধিক মানুষ আবেদন নিয়ে আসলেও জমা হয় মাত্র  ৭০ – ৮০ টি আবেদন।
এছাড়া পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, বাহির থেকে অনলাইনে আবেদন করে সকল প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসা সত্ত্বেও  ফিঙ্গার প্রিন্ট , পুলিশী ক্লিয়ারেন্সসহ এনআইডি কার্ড ও  স্থানীয় চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটের ভুল দেখিয়ে যাচাই- বাচাইকারী কর্মচারীরা আবেদন ঘুরিয়ে দিয়ে হয়রানী করছেন।কিন্ত সেই আবেদনই অফিসের পাশে থাকা কম্পিউটারের দোকানদার দালাল হাবীব, আশিক,সৌরভ,শাহিন, মোরছালিন ও আনসার সদস্য শহিদুল  মাধ্যমে অতিরিক্ত চা খাওয়ার টাকা দিলে এসব  আবেদন গ্রহণ করেন অফিসের কম্পিউটার ডাটা এন্ট্রি কর্মচারি বিশান চন্দ্র রায়সহ  অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মুরতাজ।তবে হয়রানিমুক্ত ও অতিরিক্ত টাকা ব্যয় ছাড়া সেবা চান এসব সেবাগ্রহীতারা।
পাসপোর্ট অফিস সূত্রে জানা যায়, পাসপোর্ট অফিসে আট প্রকার সেবা পাওয়া যায়। এসব সেবা হলো  ই-পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ,ই-পাসপোর্টের আবেদন যাচাই বাছাই, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি যাচাই,আবেদন অনুমোদন,ইনরোলমেন্ট সম্পন্ন করা, পুলিশি তদন্ত সাপেক্ষে পাসপোর্ট প্রিন্টে প্রেরণ,রি-ইস্যু ও সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ‍ডকুমেন্টস আপলোড  এবং প্রিন্টকৃত পাসপোর্ট বিতরণ ।তিন নিয়মে পাসপোর্ট করা হয়। একটি হলো সাধারণ  আরেকটি জরুরী ও অন্যটি হলো অতীব জরুরী।
সরেজমিনে চার দিন অনুসন্ধান করে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিস একটি হলেও  পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে ২৬ টি কম্পিউটার দোকান। এসব দোকানের বেশ কিছু দোকান থেকেই  দালাল চক্ররা চালাচ্ছেন তাদের দালালি।এসময় প্রকাশ্যে দোকানদারদের দালালী করার ছবি  তুলতে বাঁধারও সম্মুখীন হতে হয়েছিল।এ সমস্ত দালালদের মধ্যে হাবীব, আশিক,সৌরভ,শাহিন ও মোরসালিনসহ বেশ গুটি কয়েকজন দালালরা পাসপোর্ট অফিস সামনে আনাগোনা করে থাকেন।এছাড়া  এবছরের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে দুদক অভিযান চালিয়ে সোহেল ,রুবেল ও কাঞ্চণ নামের দালালদেরকে আটক করলেও জেলখানা থেকে বের হয়ে তারা আবার চালাচ্ছেন দালালী।
ভুক্তভোগী সাইফুল মিয়া অভিযোগ করে বলেন,  বিশান স্যার ঘুষ  ছাড়া সঠিক আবেদন ফেরত দেয়। আমি তাকে ফিঙ্গার পিনের জন্য ১৫’শত টাকা দিয়েছি তারপর কাজ হইছে ।প্রথমে এই টাকা না দিলে সাত দিন ঘুরিয়েন তিনি।
এদিকে পাসপোর্ট সেবা নিতে আসা হজ যাত্রীর স্বজন  আব্দুল আরিফ বলেন, বুড়া মানুষগুলোকে নিয়ে এসে হয়রানিতে পরলাম। সঠিক আবেদন নিয়ে আসলেও বিভিন্ন অজুহাতে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন এখানকার কর্মচারিরা।
অপরদিকে নলডাঙ্গা থেকে পাসপোর্ট  নিতে আসা মো. নুরুন্নবী নামের এক যুবক বলেন,দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছে সঠিক সময়ে যদি পাসপোর্ট  দিত তাহলে কাজ বাদ দিয়ে বারবার ঘুরতে হতো না।  নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট বহি দিলে আমরা উপকৃত হতাম।
প্রথম দিন রবিবার (১ ডিসেম্বর) অনুসন্ধানে এক দালাল চক্রের সদস্য মোরছালিন মিয়া বলেন  সাংবাদিক ভাই এখানে যে, আমার দুই একটি কাজ করে দিবেন আপনিও ভাগ পাবেন। এখানে তো সাংবাদিকরাও এসে কাজ করে। দিনে পাঁচটি কাজ করলে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পাবেন ভাই! আমার দুই একটা কাজ করে দেন। সাংবাদিক গেলেই কর্মচারীরা কাজ করে দেন খুব তাড়াতাড়ি। এই দালালের কথা শুনে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করার জন্য  সাধারণ সেবা গ্রহীতা সেজে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে আনসার বাহিনীর সদস্য শহিদুল মিয়া পথরোধ করে বলেন কোথায় যাচ্ছেন?  কি করবেন?এসব বলে পাশে নিয়ে গিয়ে পাসপোর্টের আবেদন  করে  দেয়ার কথা বলে অতিরিক্ত দুই হাজার টাকা চান। পরে পাসপোর্ট করতে চাইলে ফোন নাম্বার হাতে ধরিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন এই আনসার সদস্য।
দ্বিতীয় দিন সোমবারও(২ ডিসেম্বর) অনুসন্ধানে গেলে দেখা মেলে গোবিন্দগঞ্জের নাম পরিচয় না জানা এক হজযাত্রীর। তিনি বলেন, সঠিক আবেদন করার পরও যাচাই -বাচাইকারী  কম্পিউটার অপারেটর আমাকে ঘুরাচ্ছেন। পরে  অনুসন্ধানের জন্য  দূর থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। এরপর  পাসপোর্ট অফিসের সামনে উত্তেজিত হয়ে চিল্লাচিল্লি করছিলেন এই হজ যাত্রী। বলছেন সেনাবাহিনীর কাছে যাব, সেনাবাহিনীর কাছে যাব, সঠিক আবেদন নিয়ে আসার পরেও ঘুরাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে গোপনীয়তা ছেড়ে   তার কাছে গেলে তিনি জানান তার ভোগান্তির কথা। পরে পাসপোর্ট অফিসে সিসি ক্যামেরায়  সাংবাদিক দেখে অফিসের কর্মকর্তা উপরে ডেকে নিয়ে গিয়ে সেই হজ যাত্রীর আবেদন গ্রহণ করেন। পরে আবেদনকারী এসে খুশি হয়ে বলল বাবা তোমার জন্য  আমার আবেদন টা গ্রহণ করল তা না হলে চার ঘন্টা থেকে হয়রানি করছিল আবেদন যাচাই বাচাই কারী  কম্পিউটার ডাটা অপারেটর  বিশান চন্দ্র রায়।  তবে সেই হজ যাত্রীর নাম একাধিকবার  জানতে চাইলে পাসপোর্ট না হওয়ার ভয়ে নাম বলেন নি।
এরকম বেশ কিছু ভুক্তভোগী সাথে  বাকি দুদিন বুধবার ও বৃহস্পতিবারও দেখা মিলেছিল।  তারাও অভিযোগ করছেন, এই আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারীরা টাকা ছাড়া  কোন কাজ করেন না । মুখ দিয়ে টাকা না বললেও গোপনে দালালের মাধ্যমে টাকা নেন এই অফিসের কর্মচারিরা।
তবে নাম পরিচয় অনিচ্ছুক এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, পাসপোর্ট অফিস এখন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।বিগত সময়ে দুদক অভিযান চালানোর পরে তিনজন দালালকে আটক করলেও এই অফিসের দালালী কোন ভাবেই কমছে না বরং আরো বেড়েছে।সব সময় পাসপোর্ট অফিসের আশে পাশে থাকে দালালদের পদচারণা। দ্রুত হয়রানি মুক্ত পাসপোর্ট অফিসের দাবি  করছি।