আজ শুক্রবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্যের সাথে হারিয়ে গেছে ছনের ঘর 

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৫, ০৪:০৫ অপরাহ্ণ
ঐতিহ্যের সাথে হারিয়ে গেছে ছনের ঘর 

Sharing is caring!

তিমির বনিক,মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
প্রাচীনতম এক সময়ের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ছিল ছনের ঘর। কয়েক দশক আগেও মৌলভীবাজারের কুলাউড়াসহ বিভিন্ন উপজেলায় ছনের ঘর দেখা যেত। এখন আর সেটি দেখা যায় না। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রাচীন ঐতিহ্য।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌলভীবাজারের চা বাগানের ভিতর ঐতিহ্যের নিদর্শন ছিলো ছনের ঘর। গ্রামীণ এলাকার গরিব-মধ্যবিত্তের বাড়ি ঘরের ছাউনির একমাত্র অবলম্বন ছিল এই ছন। সেই সময় ছন মাটি কিংবা বেড়ার ঘরে ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সেইসময় পাহাড় থেকে ছন কেটে শুকিয়ে তা বিক্রির জন্য ভার বেঁধে হাটে নিয়ে যাওয়া হতো। এক সময় এলাকা ভিত্তিক ছনখোলা হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। চা বাগানে মালিক পক্ষ শ্রমিক দিয়ে ছন কেটে শুকিয়ে বাগানে ছনের ঘর তৈরি করে দিত। পুরো গ্রামে চলতো  ছনের ঘর বানানোর আমেজ। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোঁখে পড়ে না।
আধুনিক সভ্যতায় মানুষ এখন পাকা-আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করছে টিনকে। পাহাড়েও এখন আগের মতো ছন পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গ্রাম থেকে ছনের ব্যবহার ক্রমশ বিলুপ্তির পথে।
কুলাউড়া উপজেলার জয়নুল নামের একজন দিনমজুর জানান, আগের মতো ছন পাওয়া যায় না পাহাড়ে। আগের মতো পাহাড় ও নেই।  যে জায়গায় ছন হতো  সেখানে আর হয়না, কিংবা উজাড় করে অনান্য চাষাবাদ হচ্ছে । আগে প্রতিবছর ঘরে পুরনো ছনের ছাউনি সরিয়ে নতুন করে ছন ব্যবহার করা হয়। কেউ অর্থাভাবে কেউ আরামের জন্য টিনের পরিবর্তে ছনকে ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করতেন ।
ব্যবসায়ী রিতন পান্ডে জানান, আগে তাদের দোকান ছনের তৈরীর ছিলো। সেখানেই ব্যবসায়ীক কার্যক্রম চলত । সময়ের সাথে পরিবর্তন করে এখন পাকার দোকান দিতে হয়েছে।
জানা যায়, গ্রামে ছনের ছাউনির ঘর তৈরির জন্য  কিছু কারিগর ছিলেন। তাদের দৈনিক মজুরি ছিল ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। প্রথমে পুরাতন ছন তুলে নেওয়া হতো। ঘরের নতুন নতুন বাঁশ লাগানো হতো পুরাতন বাঁশ তুলে। তারপর নতুন ছন উপরে তোলা হতো। এরপর আগার পাতলা অংশ কেটে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপে ছাউনি বাঁধা হতো।
উপজেলার সবকটি বাজারে ছনের ছাউনি দিয়ে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে তার নিচে বাজার বসতো। কালের বিবর্তনে মৌলভীবাজারের সবকটি উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে এখন ছন খুব কমই দেখা যায়। সাধারণ গ্রামের মানুষ ঘর তৈরিতে ছাউনি হিসেবে আগের মতো ছনের ব্যবহার করেন না।
কুলাউড়া উপজেলার সনজিৎ বলেন, এখন আর মাঠে-ঘাটে, হাট-বাজারে ছন দেখা যায় না, গ্রাম্য এলাকায়ও ছনের ঘর এখন সহজে চোঁখে পড়েনা। ছন আর ছনের ঘর আরও কিছুদিন গেলে একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
উপজেলার কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছনের ঘরে বসবাস করা খুবই আরামদায়ক। ছনের ঘর গ্রীষ্মকালে ঠাণ্ডা ও শীতকালে গরম থাকে। ছনের ঘর তৈরি করার ঘরামি বা মিস্ত্রীর খুব কদর ছিল।
প্রকৃতি প্রেমি কামরান আহমদ বলেন, সময়ের পরিবর্তনে এখন ছনের ঘর বানিয়ে ক্যাফে তৈরী হচ্ছে। শহরের মানুষ ছনের বেড়া আর ছনের তৈরী নান্দনিক ঘরে আনন্দের সাথে কিছু সময় পার করছেন। এই ঐতিহ্যকে বাঁচাতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
পার্কের দর্শনার্থীদের বিশ্রামের জন্য বৈঠকখানায়, শখের রেস্টুরেন্ট, পাকা বাড়ির সামনে কিংবা বাগানে বসে আড্ডা দেওয়ার ঘর অথবা কোনো শুটিং স্পটে। অনেকের কাছে ছনের বাহারি ব্যবহার দেখে মনে হয় আধুনিকতার এক অনন্য ছোঁয়া। অনেকের পাকা বসতঘরের উপর তলায় ছনের তৈরি ছোট ঘরটিকে ঐতিহ্যের রুপ দেয়। চিরচেনা এই ছন তৎকালে ঘরের ছাউনির জন্য শতভাগ ব্যবহার হতো। ছনই ছিল ঘরের চালার একমাত্র ভরসা।
মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে জীবন মানের ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।আর তাই হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালিদের চিরচেনা ঐতিহ্যবাহী এই চিহ্নটি। হয়তো সেই দিন আর বেশি দুরে নয়, খড়ের ছাউনির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজম্ম রূপকথার গল্পে এই ঘরকে স্থান দিতে স্বাছন্দবোধ করবে।