আজ মঙ্গলবার, ৪ঠা নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৯শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নিউইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৭:১৪ অপরাহ্ণ

Sharing is caring!

Manual5 Ad Code

‘লেখকের জীবনবোধ দ্বারা জারিত ও চিত্রিত বাইরের পৃথিবীর জনজীবনের যে বাস্তবচিত্র কথাশিল্পী আঁকেন তা তাঁর অন্তর্গত ক্ষরণেরই আরেকটি রূপ!’— আহমাদ মাযহার (বদরুন নাহারের গল্প বিষয়ে আলোচনায় মন্তব্য)

Manual2 Ad Code

আবেদীন কাদের

এসপ্তাহের আড্ডা শুরু হয় একটু দেরিতে, প্রায় সারে সাতটার দিকে। সকল রেকর্ড ভেঙ্গে সবার আগে এসে পৌঁছেন কথাশিল্পী বদরুন নাহার ও কবি-স্থপতি অভীক সোবহান। আমরা তিনজন বসে কথা বলা শুরু করি। কয়েক মিনিটের মধ্যে আহমাদ মাযহার এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন।

Manual7 Ad Code

অভীক ও বদরুনকে একা পেলে আমি ফরিদপুর বিষয়ে হাজারটা কথা বলা শুরু করি। আমার ছেলেবেলার প্রিয় শহর ফরিদপুর। আমরা কথা বলছিলাম আমাদের ফরিদপুরের কয়েকজন বন্ধু সম্পর্কে। কিচলু ভাই বেশ কিছুদিন ধরে কিডনি সমস্যায় ভুগছেন আমারই মতো। তাঁর সঙ্গে খুব একটা কথা হয় না আজকাল। মুনীর ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা হয় না। আমি যেহেতু ঘর থেকে একেবারেই বের হই না তাই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় কম। এসব বিষয়ে কথা বলার সময় যথারীতি আমাদের সাহিত্যের আরও দুয়েকটি বিষয়ে কথা শুরু হলো।

Manual2 Ad Code

আমি মাযহারের কাছে জানতে চাইলাম আমাদের লেখকরা যারা দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র নৈকট্য লাভ করে, অর্থাৎ এই দল দুটির কাছ থেকে ধান্দা করে জাগতিক স্বার্থ আদায় করতে চায়, তারা কী কারণে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের লেখা বিষয়ে এতোটা সোচ্চার! কেন আজকাল এই ছাত্রদের দ্বারা হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন করে নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি, সংবিধানে সেটা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি, ইত্যাদি সংবাদ মাধ্যমে এতো জোরালো হয়ে আসছে! নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিশেবে রাষ্ট্র ঘোষণা দিলে বা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলে এসব কবি সাহিত্যিকদের কী লাভ-ক্ষতি, বা তাদের সাহিত্যের কী ক্ষতি বৃদ্ধি হবে! নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করলে কবি আবদুল হাই শিকদারের কবিতার মান কি বদলাবে, নাকি যা আছে তাই থাকবে, বা কবি কামাল চৌধুরীর কবিতার মানে কি কিছু পরিবর্তন হবে! তা যদি না হয় তাহলে এগুলো নিয়ে আবদুল হাই শিকদারের এতোটা তৎপর হওয়ার কী আছে! মাযহার আমাকে এবিষয়ের অন্তরালে রাজনীতিটা কিছুটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আমার মাথায় খুব বেশি একটা কিছু ঢুকলো মনে হয় না। বিশেষ করে ‘জাতীয় কবি’ বলতে আসলে কী বোঝায়? কেন একটি দেশের জাতীয় কবি থাকতে হবে! হুইটম্যান কি মার্কিনীদের জাতীয় কবি, বা ওয়ার্ডসওয়ারথ, স্পেনডার, অডেন বা অন্য কেউ কি ইংলনডের জাতীয় কবি! ভারতের বা পাকিস্তানের জাতীয় কবি কে! আমি অবশ্য এসম্পর্কে কিছুই জানি না। কবিতা বা গল্প মানুষ পড়েন বা পড়ে যা তাদের ভাল লাগে তারা তাদের প্রিয় কবি বা লেখক। এতে অন্যদের বা রাষ্ট্রের কী করার আছে। মাযহার জানালেন প্রতিটি জাতির নিজস্ব জাতীয়তাবোধের প্রতীক যদি কোন কবি সৃষ্টি করেন তাঁর বিষয় অবশ্য আলাদা হতে পারে। কিন্তু অনেক দেশেই খুব শক্তিশালী কবি যদি রাষ্ট্রের কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর রাজনীতিকে পরিহার বা বিরোধিতা করেন, তাঁকে হয়তো সেই গোষ্ঠীর শাসকদের দ্বারা মাঝে মাঝে অত্যাচারিত হতে হয়, কিন্তু কাব্যবিচারে সেই কবিকে মানুষ হয়তো গভীরভাবে শ্রদ্ধা করে। পাকিস্তানের কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের কাছে চক্ষুশূল ছিলেন, তাঁকে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সাজ্জাদ জহীরের সঙ্গে পাকিস্তান সরকার হেনস্থা করেছিলো রাষ্ট্রবিরোধী কাজের জন্য। ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের স্ত্রী এলিজাবেথ ফয়েজ তাঁর লেখা স্মৃতিকথায় সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। বাংলাদেশে আশির দশকে কোন কোন কবিকেও জেনারেল এরশাদের অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছিলো। এতে সেই কবিদের কবিতার গুণগত মানের তো কোন হেরফের হয় নি। বা বলা যায় অনাগত কাল নিশ্চয় তাঁদের কবিতাকে ভিন্নভাবে মূল্যায়নও করবে না। কিন্তু রাষ্ট্রের শাসক যখন দুরাচারি হয় তখন তারা তাদের দুরাচারিতার সমর্থক হিশেবে কবি সাহিত্যিকদের উৎকোচ বিলিয়ে নিজেদের দলে ভেরান। এটা বিশেষ করে ঘটে স্বৈরশাসকদের সময়ে। বাংলাদেশে এটা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে জেনারেল এরশাদের শাসনকালে।
কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমাদের দেশে সত্তর দশক থেকেই এক ধরণের রাজনীতি হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক নামকরা কবি লেখকদের মতোই নজরুল ইসলামের জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। তিনি অনেকদিন যাবৎ দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন, বাকশক্তি হারিয়েছিলেন চল্লিশের দশকে। কিন্তু সত্তর দশকের গোড়ায় বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে তাঁকে ঢাকায় এনে কিছুটা ভাল চিকিৎসা ও আর্থিক আনুকূল্য দেয়ার চেষ্টা করেছেন, এটাতে তাঁর সাহিত্যের কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হয় নি। কিন্তু বিষয়টা কিছুটা মানবিক ছিলো সন্দেহ নেই। যে বিষয়টি রাষ্ট্রের জন্য ও সাহিত্যের জন্য ভাল হয় সেটি হলো নজরুলের সাহিত্য বিষয়ে গবেষণার জন্য উদ্যোগ নেয়া, কবির সকল সাহিত্যকর্ম সুলভে যাতে পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করা। নজরুল ইসলামের কবিতা কেমন মানের এবিষয়ে যদি বিস্তর গবেষণা ও লেখা হয়, সেটি ভাল কাজ। আমি নিজে নজরুলের সাহিত্যের গভীর পাঠক নই, আর দশজন সাধারণ পাঠকের মত সামান্য পাঠ করেছি, তাই আমি এই তক্কাতক্কিতে কখনও যোগ দেই না। মাযহার ও আমার অনেক বন্ধু নজরুলের সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক, তাঁদের মতামত আমি শুনেছি। এক সময়ে অনেকদিন দীর্ঘ আলোচনা শুনেছি কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের কাছে। মান্নান ভাই খুবই নজরুল অনুরাগী গবেষক। তিনি জীবনের অনেকটা সময় নজরুলের সাহিত্য বিষয়ে লিখে ও গবেষণা করে কাটিয়েছেন। যে ধরণের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা ও কথাশিল্প আমার প্রিয়, নজরুল ঠিক সে-ধরণের কবিতা লেখেন নি। তাই আমার নজরুল-অনুরাগী বন্ধুদের বক্তব্য অনেক সময়ই আমার কাছে ঠিক বোধগম্য নয়, কারণ আমি তাঁদের মতো নজরুলের লেখার নিবিড় পাঠক নই। তাই আমি তক্কাতক্কিতে জড়াই না। এই আড্ডায়ও মাযহার নজরুলের যে-সকল কবিতাকে অসাধারণ কবিতা হিশেবে উল্লেখ করলেন, তা আমার মেনে নিতে একটু কষ্ট হলো। আমার মনে ‘আধুনিক কবিতার’ সংজ্ঞা’ যেমনটা প্রোথিত হয়ে আছে, তাতে নজরুলের কবিতাকে আমি সেই সংজ্ঞানুযায়ী ফেলতে পারি না। তবে জগতে মহৎ কবিতা তো বিভিন্ন রকমের হয়, সেদিক থেকে হয়তো মাযহারের দাবি সঠিক! কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা নিয়ে সত্তর দশকে মাতামাতি শুরু হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাবাহিনী যখন ক্ষমতা দখল করেছিলো তার পর থেকে এক শ্রেণীর সাহিত্য সমালোচকরা নজরুল ইসলামের সাহিত্যকে মহিমান্বিত করে লেখা শুরু করেন। আমাদের বিভিন্ন আড্ডাতেও এর ঢেউ এসে লাগে। বোঝা যাচ্ছিলো এই অতিথি কবি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কারও কারও জাগতিক ধান্দার জন্য কবি বাংলাদেশের রাজনীতির ঘোলা জলে পড়েছেন। তবে আমাদের এদিনের আড্ডায় মাযহার আমার একটি প্রশ্ন মন দিয়ে শোনেন এবং একটি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন তাঁর মতো করে। আমার প্রশ্নটি ছিলো , জাতীয় কবি কাউকে করার খুব একটা প্রয়োজন রাষ্ট্রের রয়েছে কিনা, আর থাকলেই একজন অসুস্থ মানুষকে বিদেশ থেকে ধরে এনে, যিনি জন্মেছেন ভিন্ন দেশে, অতিথি করে এনে এটা করার প্রয়োজন কী! বাংলাদেশে জন্মেছেন, সারাজীবন এখানেই লিখেছেন বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমেদ বা আরও অনেকেই রয়েছেন, তাঁদের কাউকে করলে ক্ষতি কী! তবে গত পনেরো বছর বাংলাদেশের সাহিত্যে কী ঘটবে, কাকে পুরস্কার দেয়া হবে, কাকে জাতীয় বা বিজাতীয় লেখক বিবেচনা করা হবে তা বেসরকারিভাবে নির্ধারণ করতো আওয়ামী সরকারের এক ডাকসাইটে আমলা কবি, যার নাম কামাল চৌধুরী। বিষয়টা বলা হতো আড়াল থেকে বেসরকারিভাবে করা হয়, কিন্তু আসলে সে সরকারিভাবেই করতো। একজন অনৈতিক দুর্নীতিবাজ, মতান্তরে ‘চোর’কে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক করতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে পরে সমর্থ হয়েছিলো। একটি অনলাইন পত্রিকার সাহিত্য-সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় লেখকদের চেক স্বাক্ষর জাল করে টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ ছিলো এই মহাপরিচালক হওয়া কবিটির বিরুদ্ধে। একটি সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী থাকার সময় অর্থ তসরুপের অভিযোগ রয়েছে, বাংলা একাডেমীতে চাকুরীর সময় একটি বিভাগের পরিচালক হিশেবে কয়েকবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ মেশিন ঠিক করার নামে টাকা তুলে নিয়েছে। মহাপরিচালক হিশেবে সৈয়দ শাহেদ আহমেদ আসার পর তদন্তে এই চৌর্যবৃত্তি ধরা পড়ে। বাজারে জোর গুজব, এই লোককে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক বানিয়েছিলো কামাল চৌধুরী। তার অনেক কুকর্মের মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। নিজে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদকসহ যত রকম পুরস্কার নেয়া সম্ভব, কামাল চৌধুরী সবই করতলগত করেছে। ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগের মতোই বিএনপি ক্ষমতায় এলে একই ধরণের বা কাছাকাছি কাজ করে কবি আবদুল হাই শিকদার। এবার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি করে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে এই কবি বেশ দৌড়ঝাপ করছে। আসলে কবি বা বুদ্ধিজীবী যখন কোন রাজনৈতিক দলের তাবেদার হয়ে দাঁড়ায় তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় আমাদের সাহিত্যের বা শিল্পের। এটা আসলে সত্তর ও আশির দশকে সেনা শাসকদ্বয়ের সময় থেকে সৈয়দ আলী আহসান বা ফজল শাহাবুদ্দীনের কার্যকলাপ থেকে আমরা দেখে আসছি! সাহিত্য বা শিল্পকে রাজনৈতিক দলের ত্রিসীমানার মধ্যে ঢুকতে দেয়া ঠিক নয়। যদি কোন কবি সাহিত্যিক বা শিল্পী এরকম উদ্যোগ নেয়, তাহলে সম্মিলিতভাবে সকল কবি সাহিত্যিকদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিৎ। আমরা আড্ডায় এসব নিয়ে কথা বলছিলাম, কিন্তু প্রায় সকলেই মত দিলেন যে এই ‘সম্মিলিতভাবে’ কথাটা বাদ দিতে হবে আলোচনা থেকে, কারণ শুধু রাষ্ট্র বা সমাজ ও রাজনীতিই দেশে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে তা নয়, আমাদের সাধারণ মানুষের জীবনও আলাদা হয়ে গেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আগস্ট মাসের পাঁচ তারিখের পর থেকে প্রেস ক্লাবের দখল থেকে পাড়ার চাঁদাবাজির দখল পর্যন্ত দেশের সবকিছুরই ক্ষমতা বদল ঘটে গেছে মুহূর্তের মধ্যে। পাড়ায় পাড়ায় নতুন বাড়ি গড়তে চাঁদা, বাসস্ট্যান্ড, ফেরিঘাটে, গ্রামের হাটে বাজারে চাঁদা, দৌলতদিয়া ঘাট থেকে দেশের সকল বেশ্যাবাড়ির চাঁদাবাজিতেও দলবদল হয়ে গেছে। তাই ‘সন্মিলিতভাবে’ কিছু করা হয়তো আমাদের সমাজে আর সম্ভব হবে না। কবি এবিএম সালেহউদ্দীন এসব কথায় সাধারণত নীরব থাকেন, তিনি রাজনৈতিক এই তক্কাতক্কির মাঝে একটু প্রতিবাদের সুরে বলে উঠেছিলেন দেশের স্বৈরশাসনের পতন ঘটলো কয়েক সপ্তাহ আগে এবং তা ছাত্রদের সঙ্গে সবার ‘সন্মিলিতভাবেই’! কিন্তু সালেহউদ্দীনকে শুধরে দিয়ে আমি বলেছি সেটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে কোন কোন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সদস্যদের পরিচয় গোপন করে, সেটা জনগণের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। সেই পরিচয় সামনে এনে এই আন্দোলন সফল করা অসম্ভব ছিলো। তাছাড়া আরও কিছু আন্তর্জাতিক সূত্রও কাজ করেছে গোপনে কিছুটা প্রতারণার ছলেই!
তাই এই অভুথান সন্মিলিতভাবে হয়েছে বলা কঠিন। আড্ডার তক্কাতক্কি অতিরিক্ত রাজনীতি-ঘেঁষা হয়ে যাচ্ছে দেখে মাযহার আলোচনাটা সাহিত্যের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। আমাদের নিউ ইয়র্কের লেখকদের লেখা বিষয়ে আমরা বেশ কিছুদিন ধরে সিরিয়াসলি কিছু লেখা তৈরি ও বিভিন্ন সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আলোচনা করার প্রয়োজন নিয়ে ভাবছিলাম। এবিষয়ে অনেকদিনই বলেছেন কবি শামস আল মমীন। মমীন ভাই অনেকদিন ধরেই বলে আসছিলেন যে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, টরোনটো বা বার্লিনে যে অগণিত তরুণ কবি, কথাশিল্পী ও লেখক রয়েছেন, তাঁদের লেখা নিয়ে গবেষণা বা নিয়মিত অন্তত প্রবন্ধ লেখা উচিত আমাদের। কারণ বছরের পর বছর হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে এসকল লেখকরা প্রবাসে লেখা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু আমাদের ঢাকার সাহিত্য পত্রিকাগুলো বা সাহিত্য সমালোচকরা এঁদের লেখা বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা লেখেন না। কোথায় এঁদের লেখায় দুর্বলতা বা কোথায় কোথায় এঁদের লেখায় সম্ভাবনা দেখা যায় তা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লেখা হয় নি তেমন। দুচারজন লেখক কিছু চেষ্টা করেছেন লিখতে, কিন্তু তা একেবারেই যৎ সামান্য। এঁদের লেখা বিশ্লেষণ করে নিয়মিত লেখা হওয়া জরুরি। নিউ ইয়র্কের সাহিত্য একাডেমী প্রায় দেড় দশকের কাছাকাছি সময় নিয়মিত অনুষ্ঠান করে এঁদের লেখা পাঠ ও আলোচনা করার চেষ্টা করছে। এই সাহিত্য একাডেমীর পরিচালক মোসাররফ হোসেন সর্বক্ষণ প্রবাসী এই তরুণ লেখকদের লেখার মানোন্নয়নের জন্য সচেষ্ট, তিনি শুধু লেখকদের দিয়ে লেখান তাই নয়, বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকদের দিয়ে প্রবাসী লেখকদের বিষয়ে আলোচনারও চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা প্রশংসনীয়। আমি বছর তিরিশ আগে কথাশিল্পী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও লেখক হাসান ফেরদৌসের পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত ‘সাহিত্য অনুষ্ঠান’-এ উপস্থিত থেকে দেখেছি, অনেকের লেখা পড়া হতো, আলোচনা হতো, কিন্তু তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় নি। যদি বিষয়টা শুধু আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে কোন ত্রৈমাসিক বা ষাণ্মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব হতো ভাল সম্পাদকের আনুকূল্যে, তাহলে বিষয়টা অনেক ভাল হতো বলে মাযহার ও এবিএম সালেহউদ্দীন মন্তব্য করেন।
আড্ডায় এরপর কথা ওঠে কথাশিল্প নিয়ে। আমাদের মাঝে একমাত্র নিয়মিত গল্প লেখেন বদরুন নাহার, স্বপন বিশ্বাস, মনিজা রহমান ও আরও দুয়েকজন। আদনান সৈয়দ মাঝে মাঝে লেখেন। নসরত শাহকে না-লিখলে পিটিয়ে পশ্চাদদেশের ছাল তুলে নেয়া হবে বলে হুমকি দেয়ার পরও তাঁর আলস্যের রেশ কাটে নি, এখনও কলম ধরার সময় করে উঠতে তিনি পারছেন না। তবে শিগগীর কলম ধরবেন এই আশা। সম্প্রতি কৈশোর প্রেমের একটি মিষ্টি গল্প অনেকদিন পর লিখে আমাদের মুগ্ধ করেছেন কবি এবিএম সালেহউদ্দীন। মাযহার কবিতা আর প্রবন্ধ নিয়েই সবটুকু সময় ব্যয় করছেন। আমি সত্তর ও আশির দশকে কিছু গল্প লিখেছিলাম। এরপর অনেকদিন গল্প লেখা হয়নি, কিন্তু কছুদিন আগে আবার নতুন করে কয়েকটি গল্প লিখেছি। বছর কুড়ি আগে ‘প্রথম আলো’ সাময়িকীতে কয়েকটি গল্প লিখেছিলাম। এরপর একটি উপন্যাস লিখে কোথাও ছাপি নি, ভেবেছিলাম ফেসবুকের বন্ধুদের জন্য দেই, কয়েক কিস্তি দেয়ার পর এক লেখক বন্ধু পরামর্শ দিলেন ফেসবুকে পুরো উপন্যাস না ছাপতে। এটা নাকি উপন্যাসের জন্য খুব ভালো নয়। তাই পনেরো কিস্তির পর আর দেই নি। যদিও এই উপন্যাসটির প্রতি আমার নিজের কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে ভিন্ন কারণে! এছাড়া আমার বেশ কিছু অপ্রকাশিত গল্প ও কবিতাও রয়েছে। আমাদের কথাশিল্পী বন্ধু তানভীর রব্বানী কেন জানি না আমার গল্পের ভাষা ও নির্মিতি খুব পছন্দ করেছিলেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের মধ্যে আবু সাইদ জুবেরী, আহমদ বশীর ও জাহিদ হায়দারসহ অনেকেই দারুণ গল্প লিখতেন, কিন্তু সে-সময় আমি একেবারে ভিন্ন রীতিতে গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলাম। আমার কথাশিল্পী বন্ধু সারোয়ার কবির সেই পঁয়তাল্লিশ বছর আগে গল্পগুলো ‘বিপক্ষে’ ও অন্যান্য পত্রিকায় পড়ে আমাকে বলেছিলেন, আমার গল্পের চরিত্ররা নাকি ভিন্ন ভূখণ্ডের বাসিন্দা, তারা মিনিংলেসনেসের শিকার, তারা হতাশাগ্রস্ত ও কল্পনার জগতে সারাক্ষণ উড্ডীন, তাদেরকে নাকি আমাদের পাঠকরা চেনেন না। তারপর আমি গল্প অনেকদিন লিখি নি, কারণ আমার নিজেরও মনে হয়েছে আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার বিহার কোথায় যেন পাঠকের অভ্যাসের সঙ্গে ঠিক মেলে না, একটা দূরত্ব রয়েছে। কিন্তু কিছুদিন আগে রাব্বী যা বললেন গল্পগুলো সম্পর্কে, তাতে মনে হয় সেই পুরনো নির্মিতিতে গল্প খুব মন্দ হয় নি! হয়তো আবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
এসময় মাযহার হঠাৎ করেই বদরুনের গল্প বিষয়ে কথা বলছিলেন। মাযহার জানালেন আমাদের সবার পছন্দ বদরুনের গল্প, কিন্তু বদরুনের গল্পের আঙ্গিক খুব সুন্দর হলেও বদরুনকে কিছুটা ভাষা বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। বদরুনের বেশ কয়েকটি গল্পের প্রটাগনিসট সমাজের খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। তাদের দুঃখ বা আনন্দ আমাদের অনেকের কাছেই অচেনা, আমাদের সে-জীবনের অভিজ্ঞতা নেই বলে। গার্মেন্টস শ্রমিক একটি মেয়ের ট্র্যাজিক জীবন নিয়ে অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন বদরুন। এছাড়া অন্যান্য পেশার শ্রমিকদের নিয়ে তাদের জীবনের ভাষা ব্যবহার করে বদরুন খুব শক্তিশালী গল্প লিখেছেন। এই আড্ডাতেও বদরুন একটি দরিদ্র তরুণীর বিয়ে, নতুন জীবন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার বাবা মা ও নতুন স্বামীর জীবন নিয়ে ভীষণ অন্য রকম একটি গল্প পড়ে শোনালেন। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন গল্পটিতে, কিন্তু চরিত্রায়ণ সত্যিই আমার খুব ভালো লেগেছে। এই গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র একজন অন্ধ মানুষ। অন্ধ মানুষের অনুভূতি ভিন্ন রকম হয়, তারা কীভাবে বস্তুকে বা জীবনের প্রতিটি বিষয়কে অনুভব করে, তা এই গল্প পড়ে একটু ভিন্নভাবে বোঝা সম্ভব। আমার প্রিয় কথাশিল্পী ও ইংরেজি ভাষার লেখক ভেদ মেহতা প্রায় দশটি খণ্ডে বিভিন্ন নাম দিয়ে আত্মজীবনী লিখেছেন, সেখানে তাঁর জীবন বর্ণনার অত্যন্ত শক্তিশালী উৎস তাঁর অনুভূতি। মেহতা চার বছর বয়সে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর সারাজীবন স্কুলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া ও নিউ ইয়রকার পত্রিকায় প্রায় সারে তিন দশক চাকুরি ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে ও লিখে জীবন কাটিয়েছেন। ইংরেজি ভাষার একজন শক্তিশালী সমকালীন লেখক তিনি, কিন্তু তিনিই আমাদের প্রথম বুঝিয়েছিলেন অন্ধদের অনুভূতি, গন্ধ ও স্পর্শের ক্ষমতা স্বাভাবিক সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রখর। বদরুনের এই গল্পটি শুনতে শুনতে বার বার আমার ভেদ মেহতার আত্মজীবনীর খণ্ডগুলো ও অন্যান্য লেখার কথা মনে পড়ছিলো, বিশেষ করে তাঁর গবেষণামূলক ইতিহাস ও উপন্যাসের কথা! বদরুনের এই গল্পের অন্ধ বাবার চরিত্রটি একেবারে ভিন্নভাবে চিত্রিত হয়েছে! ‘হরিদাসের বাড়ি’ শিরোনামের এই গল্পটি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো বেশ কয়েক বছর আগে। বদরুনের গল্পটি পাঠের সময় আমার মন একেবারে মোহ্যমান হয়েছিলো অন্ধ চরিত্রটির প্রতি, আমি বদরুন চিত্রিত তার অন্তর্গত সত্তাটি বোঝার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু পুরো সময়টা জুড়ে ভেদ মেহতার বিভিন্ন লেখা আমার স্মৃতিতে এসে কেমন স্তব্ধ করে দিচ্ছিলো আমার ভাবনা। এসময় মাযহার কথাশিল্পের বিভিন্ন তাত্ত্বিক দিক নিয়ে কিছু মূল্যবান কথা বললেন, বদরুনের গল্পের ফর্ম বা ভাষা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। অনেকদিন আগে পড়েছিলাম কবিকে কবিতা নিয়ে ভাবতে হয়, নাট্যকারকে নাটক, কিন্তু কথাশিল্পীকে বিজ্ঞান থেকে মনোবিজ্ঞান ও দর্শন থেকে ভূগোল, জগতের কত কী বিষয় নিয়েই না ভাবতে হয়! শুধু ভাবতে হয় না, বরং তাঁর সময়, সময়ের সৈকতে বিভিন্ন বিষয়ের রেখে যাওয়া ছাপকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে চরিত্রগুলোর মনোজগৎ সৃষ্টি করতে হয়। তাই এর ভাষা যেমন এক জটিল বাহন, তেমনি এর নির্মাণ বিষয়েও কথাশিল্পীকে সারাক্ষণ সজাগ থাকতে হয়! মাযহার খুব জোর দিয়ে বদরুনের গল্প বা উপন্যাস বিষয়ে যেসব কথা বলছিলেন তার মধ্যে জীবনের সমগ্রতাবোধ, ভাষা ও নির্মাণরীতি ছাড়াও অন্যান্য বিষয় ছিলো। তাঁর মতে লেখকের জীবনবোধ কথাশিল্পের মাঝে পূর্ণবৃত্ত হয়ে উঠতে পারছে কিনা তা আবশ্যিকভাবে বিচার্য। একদিকে যেমন দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’র নায়কের তীব্র যন্ত্রণাবোধ, বা ‘রেজারেকশন’- এর নেকলুডফ চরিত্রের অন্তর্গত জটিলতা ও আত্মখোঁড়াখুঁড়ি অনেকটা লেখকের নিরাসক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়, তেমনি এই নিরাসক্তি কিছুতেই আবার বাস্তবের স্থিরচিত্র নয়, বরং লেখকের সমাজাদর্শ ও চরিটির ভেতর লেখক কর্তৃক চিত্রিত মনোজাগতিক গতি-প্রকৃতি ও ঝোঁকেরই ছবি। লেখক সম্ভবত তাঁর নিজস্ব জীবনবোধের নিক্তিতেই তা চিত্রিত করেন। মাযহার আরেকটু বিস্তৃত করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কথাশিল্পীর সৃজিত সামগ্রিকতাবোধ কেমন! লেখকের জীবনবোধ দ্বারা জারিত ও চিত্রিত বাইরের পৃথিবীর জনজীবনের যে বাস্তবচিত্র তিনি আঁকেন তা যদি সমগ্রতা পায়, তাহলে তা একটি প্যাটার্ন পরিগ্রহ করে। এই প্যাটার্ন লেখকের রচনাশৈলী, তাঁর উদ্দিষ্ট রূপকার্থ এতে নিহিত থাকে। লেখকের লেখায় এসব উপাদান সম্পূর্ণতা পেলে তা শিল্প হয়ে ওঠে। এছাড়া কথাশিল্পে আখ্যানকে কীভাবে চিত্রিত করেন আধুনিক কথাশিল্পী তাও নির্ভর করে অনেকখানি লেখকের জীবনবোধের ওপর। আখ্যানের বিভিন্ন রূপ নিয়েও মাযহার মন্তব্য করেন। অনেক সময় একই ধরনের আখ্যান যে বিপুল পার্থক্য নিয়ে চিত্রিত হতে পারে তা দেখা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বিষবৃক্ষ’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ দুটি উপন্যাসের মধ্যে। একই বিষয়, পুরুষের দ্বিচারিতা নিয়ে লিখিত হলেও দুটি উপন্যাসে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে জীবনাখ্যান চিত্রিত হয়েছে। কথাশিল্পের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আহমাদ মাযহার আমাদের সাহিত্যের, বিশেষ করে আজকের সাহিত্যের বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
অভীক ও বদরুনকে একটু পারিবারিক কাজে আগে ছাড়তে হয় আমাদের। ওঁরা দুজন বিদায় নিলে আমরা মূলত আমাদের সাম্প্রতিক কবিতার নানা বিষয় নিয়েই কথা বলছিলাম বেশ গভীর রাত অবধি!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code