আসুন দূর্ণীতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হই”—এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সুনামগঞ্জে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গণশুনানিতে অভূতপূর্ব জনসাড়া দেখা গেছে।
সোমবার (১৯ মে) সকাল ৯টায় সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাছন রাজা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ গণশুনানিতে শত শত নাগরিক অংশগ্রহণ করেন।
গণশুনানিতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুদক কমিশনার ( অনুসন্ধান) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ।
বিশেষ অতিথি ছিলেন মহাপরিচালক ( প্রতিরোধ) মো আক্তার হোসেন। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মো ইলিয়াস মিয়ার সভাপতিত্বে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার তোফায়েল আহাম্মেদ, দুদকের সিলেট সমন্বিত কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রাফি নাজমুস সাদাত, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ মহিবুল ইসলাম।
এছাড়াও জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
গণশুনানিতে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত নাগরিকরা তাদের দুর্ভোগ ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। বিশেষ করে পাসপোর্ট অফিস, ভূমি অফিস, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিক্ষা অফিস, স্বাস্থ্য বিভাগ, পৌরসভা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআরটিএ, কৃষি অফিস, সমাজসেবা, ট্রাফিক বিভাগসহ প্রায় ২৫টি সেবাদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৫০ টি নানা ধরনের হয়রানি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠে আসে।
অনেকে জানান, ঘুষ না দিলে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট মেলে না, নামজারি বা খতিয়ান পেতে হয় দালালের দ্বারস্থ হতে। কেউ কেউ বলেন, হাসপাতালে বিনামূল্যে ওষুধ মেলে না, বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হয় অবৈধ খরচ করতে। এসব অভিযোগ শুনে দুদক কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধিদের তাৎক্ষণিক জবাবদিহির আওতায় আনেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ( অব) হাফিজ আহসান ফরিদ বলেন, “সুশাসনের জন্য জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। দুর্নীতি প্রতিরোধে জনগণের সাহসী ভূমিকা আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
দুদক কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ বলেছেন, মানুষ এখন দুর্নীতির বিষয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। বিভিন্ন অফিস আদালতে মানুষ এখন মন খুলে কথা বলতে পারছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষের হাতের কাছেই এখন সব কিছু মিলছে। বাংলাদেশে বসে মানুষ জানতে পারছে থ্যাইল্যান্ড,সিঙ্গাপুর কি হচ্ছে।
যার কারণে আশেপাশে কোন অনিয়ম দুর্নীতির ঘটনা ঘটলে সাথে সাথে অডিও ভিডিও করে আমাদের কাছে পাঠাবেন। আমরা প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিব।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক রিকশা চালকরা কোনো দিনও ঘুষ খায় না- দুর্নীতি করে না। তারা ২শ টাকা ৫শ টাকাই তাদের ঘর সংসার চলে। বেশিরভাগই যাদেরকে সরকার আমানতদারি ও বিশ্বস্থ মনে করে চেয়ারে বসায় তারাই দুর্নীতি-লুটপাট করে করে।
তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পরে দুর্নীতি কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। যার কারণে প্রতিটি জেলা উপজেলা ও বিভাগীয় শহরের বিভিন্ন দপ্তরকে জবাবদিহিতার আওয়াতায় আনা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের বিষয়ে তিনি উল্লেখ করে বলেন, সুনামগঞ্জের একটা সুনাম রয়েছে, যার কারণে আপনাদের কাছে কেউ ঘুষ চাইলে সাথে সাথে চিৎকার করবেন, মানুষ জড়ো করবেন, প্রতিবাদী হবেন।
প্রতিবাদ করতে কোনো ধরনের টাকা-পয়সা লাগে না, প্রতিবাদ করতে কোনো শিক্ষা লাগে না। প্রতিবাদ করতে লাগে সৎসাহস। নিজের অবস্থানে থেকে সাহসী ভূমিকা রাখবেন, নিজেকেই একজন প্রতিবাদী দুদক মনে করবেন। তাহলেই আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে পারব।
আজকের এই গণশুনানি তারই একটি উদাহরণ।” তিনি আরও জানান, প্রাপ্ত অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই করে দ্রুত তদন্ত ও প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গণশুনানিতে প্রাপ্ত বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সমাধানও হয়েছে। এছাড়া যেসব অভিযোগ গভীর তদন্তের দাবি রাখে, সেগুলো নথিভুক্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসন ও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহযোগিতায় আয়োজিত এই গণশুনানিকে ঘিরে ইতিপূর্বে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পোস্টার, মাইকিং, লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে নাগরিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। হোসেন বখত চত্বর, ট্রাফিক পয়েন্ট, ও জেলা আদালতে স্থাপিত অভিযোগ বক্স ও ই-মেইলের মাধ্যমেও অভিযোগ সংগ্রহ করা হয়।
দুদকের এ ধরনের উদ্যোগ দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে। গণশুনানিতে মানুষের সরব উপস্থিতি প্রমাণ করে, জনগণ এখন আর নীরব নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা সচেতন ও সক্রিয়। নাগরিকদের এমন সাহসী অংশগ্রহণই একদিন গড়ে তুলবে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ এমনটাই জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকরা।