আজ শুক্রবার, ২৪শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৮ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যা প্রমাণ করেছি সেটা সন্দেহাতীত : এটর্নি জেনারেল

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ২৩, ২০২৫, ০৩:১১ অপরাহ্ণ
শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে যা প্রমাণ করেছি সেটা সন্দেহাতীত : এটর্নি জেনারেল

Sharing is caring!

Manual6 Ad Code

অনলাইন ডেস্ক:

চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধীঅপরাধে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে চলা মামলার বিচার প্রসঙ্গে এটর্নি জেনারেল মো.আসাদুজ্জামান বলেছেন, ‘এই বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি, সেটা সন্দেহাতীত।’

এই মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনাল-১ এ দেয়া সমাপনী বক্তব্যে তিনি আজ এ কথা বলেন।

বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে এটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ (প্রসিকিউসন) এই মামলা প্রমাণের জন্য দলিলিক, মৌখিক, সারকামস্টেনশিয়াল সাক্ষী উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু আসামিপক্ষ বলেছেন, আসামিরা গুলি চালানোর কোনো নির্দেশ দেননি, তাঁরা নির্দোষ। ভাগ্যিস উনি (আসামী পক্ষের আইনজীবী) বলেননি বাংলাদেশে কোনো জুলাই বিপ্লব হয়নি। ভাগ্যিস উনি বলেননি বাংলাদেশে ১৪শ’ মানুষ মারা যাননি, ৩০ হাজারের উপরে আহত মানুষ হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের ১৪শ’ মানুষ মারা গেলেন। এই ফ্যাক্টটাকে যদি আমরা সামনে রাখি, সারাদেশে এতবড় একটা জুলাই বিপ্লব হলো, সারাদেশে হত্যাকাণ্ড হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায়, সরকারের পৃষ্টপোষকতায় স্টেট অ্যাপারেটাস (রাষ্ট্রযন্ত্র) ব্যবহার করে তাহলে কে করলেন?

Manual1 Ad Code

এসময় এটর্নি জেনারেল বলেন, আদালতের কাছে আমাদের নিবেদন হচ্ছে, অপরাধ কে বা কারা করেছে, কিভাবে করেছে প্রসিকিউশনের উপস্থাপন করা সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেটি তুলে ধরা হয়েছে। আসামিরা যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, পদ্ধতিগতভাবে ব্যাপক মাত্রায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এই বিষয়টি রাষ্ট্রপক্ষ সন্দোহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। মামলা প্রমাণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ দেখিয়েছে, কার নির্দেশনা ছিল, কিভাবে নির্দেশনা ছিল, কার কাছে নির্দেশনা ছিল, নির্দেশনা কিভাবে অপারেট (পরিচালনা) করা হয়েছে, কে অপারেট করেছেন, কে এক্সিকিউট (বাস্তবায়ন) করেছেন নির্দেশনা। অভিযুক্তরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন এবং তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। উনারা এই বিচার সম্পর্কে জানেন, বিচার পর্যবেক্ষণ করছেন। এই বিচারের বিষয়ে কথা বলেছেন। এই বিচারকে প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন রকম ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছেন। ফলে এটা বলার সুযোগ নেই অভিযুক্তরা নিরাপরাধ। পালিয়ে গিয়েও তারা ক্ষান্ত হননি। বিচারকে ব্যহত করার জন্য তার সর্বোচ্চ অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল ট্র্যাইব্যুনালকে বলেন, আমি বিশ্বাস করি যে সাক্ষ্য-প্রমাণ আপনাদের সামনে এসেছে, সেই সাক্ষ্য বিশ্বের যেকোনো দেশের যেকোনো আদালতের সামনে উপস্থাপন করলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে এই আসামিদের সাজা প্রদান ছাড়া বিকল্প কোনো পথ থাকবে না আদালতের সামনে। আজকে আমরা দাঁড়িয়েছি এই বাংলাদেশেকে সভ্যতার সোপানে, একটি সামনের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই ন্যায়বিচার যদি আমরা না করতে পারি, তাহলে আমরা বাংলাদেশে মানুষ হিসেবে কবি হেলাল হাফিজের ভাষায় উত্তর পুরুষের ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবো।

এটর্নি জেনারেল বলেন, অনেকে বলছেন, খুনীরা ন্যায়বিচার পাবে কি না? বাইরে অনেক রকম কথা আছে। খুনীদের ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে ন্যায়বিচার করা হচ্ছে কিনা? আমার নিবেদন হলো- আপনারা কেবল খুনীর ন্যায়বিচার দেখবেন? ৩৬ দিনে যে ১৪শ’ মানুষ নিহত হলো, তারা কি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখেন না? যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তারা কি ন্যায়বিচার পাবেন না? রাষ্ট্র কি ন্যায়বিচার পাবে না? যারা পালিয়ে গেছে, পালিয়ে গিয়ে ন্যায়বিচারকে পরাভূত করার চেষ্টা করছে, তার পরেও তাঁদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স দিয়ে তাদের পক্ষে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়াটা কি ন্যায় বিচার না? সেখানে দিবালোকের মত সত্য এখানে মানুষ মারা গেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কারা ঘটিয়েছে, কিভাবে ঘটিয়েছে, আমরা সেটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, যদি এই আদালতে এই আসামিদের শাস্তি না হয়, তাহলে মার্টিন লুথার কিংয়ের ভাষায় বলবো, এদেশের খুন হওয়া মানুষ, পঙ্গুত্ব বরণকারী মানুষ, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা অবিচারের শিকার হবে।
এটর্নি জেনারেল বলেন, আমি প্রত্যাশা করেছিলাম উনি (শেখ হাসিনা) ন্যায়বিচারের সামনে আসবেন। উনি এক রাজনৈতিক বক্তৃতায় আরেকজন রাজনৈতিক নেতার রেফারেন্স টেনে বলেছিলেন, সাহস থাকলে বাংলাদেশের মাটিতে এসে বিচারের মুখোমুখী হোক। আমার বিশ্বাস ছিল, উনি এই কথাটা মন থেকে বলেছিলেন। আমার বিশ্বাস ছিল, উনি এটা বিশ্বাস করে বলেছিলেন। আজকে আমি দেখলাম, উনি মন থেকে বলেননি, বিশ্বাস থেকে বলেননি। উনার যদি সাহস থাকতো তাহলে উনি বাংলাদেরে মাটিতে এসে এই বিচারের মুখোমুখী হতেন।

Manual6 Ad Code

একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশ্য এটর্নি জেনারেল বলেন, ট্রাইব্যুনাল এই বিচার যত কঠিনই হোক, যত বাাঁধা আসুক, সমস্ত বাধার প্রাচীর ভেঙে যদি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা জতি হিসেবে আগামী দিনে এগুতে পারবো না। যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের অসংখ্য অগণিত মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এই আসামিদের হাতে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। পাঁচ বছরের শিশু মারা গেছে। ১০ বছরের আনাস মারা গেছে। পানি বিতরণ করা অবস্থায় মুগ্ধ মারা গেছ। বুক চিতিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়ে আবার আবু সাঈদ মারা গেছে। আমরা যদি ন্যায়বিচার শেষ করতে না পারি তাহলে বাংলাদেশের মানুষ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে একটি ভীরু কাপুরুষের উপমা হয়ে রয়ে যাবে। সেই কারণেই আমরা মনে করি এই বিচারে আমরা যা প্রমাণ করেছি, সেটা সন্দেহাতীত।

সব পক্ষের বক্তব্য শেষে ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ তিন জনের বিরুদ্ধে চলা মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলার রায়ের দিন নির্ধারণের জন্য আগামী ১৩ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।

Manual6 Ad Code

এই মামলায় প্রসিকিউসন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করেন। এছাড়া শুনানিতে প্রসিকিউটর বি এম সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি, আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অপর প্রসিকিউটররা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন। আর রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এক পর্যায়ে এই মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।

ঐতিহাসিক এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের পিতাসহ স্বজন হারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। সর্বমোট এই মামলায় ৫৪ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এই মামলাটি ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গুম-খুনের ঘটনায়। অন্য মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকার, এর দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এসব অপরাধের বিচার চলছে।বাসস

Manual4 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code