আজ সোমবার, ২৭শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১১ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বনমাতালের পথে – ছন্দের জাদুতে

editor
প্রকাশিত মার্চ ১৩, ২০২৫, ০৪:২০ পূর্বাহ্ণ
বনমাতালের পথে – ছন্দের জাদুতে

Sharing is caring!

Manual4 Ad Code

এইচ বি রিতা

২০২৩-এ কালাঞ্জলি প্রকাশন থেকে একুশের বইমেলায় এসেছে সুমন শামসুদ্দিনের ‘বনমাতালের পথে’ । এটি একটি  কাব‍্যগ্রন্থ।

প্রচ্ছদে সোহানা সোনালি সিদ্দিক। বইটি আমি সংগ্রহ করি বছর খানেক আগে, তবে বইয়ের ভেতর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় মা ও নবযাতক শিশুর মতো আলতো মায়ায় জড়ানো অক্ষর ও শব্দগুলো নিয়ে দু’বাক‍্য লেখার সাহস যোগাতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। কারণ তাঁর কবিতা সাধারণত রচিত হয় প্রথাগত ছন্দে, যেখানে প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রা থাকে, সংগঠিত বিন্যাসে কবিতার গীতিময়তা ধরে রাখতে ছন্দের পুনরাবৃত্তি থাকে এবং প্রতিষ্ঠিত কাঠামো অনুসরণ করেই কবি ছন্দবিদ্যার মূল ভিত্তির ওপর সটান দাঁড়িয়ে থাকেন। কাজেই এই কবিতাগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে নিজেকে আগে ছন্দের সেই সুসংগঠিত কাঠামো ও নিয়মকানুনের মধ্যে প্রবেশ করাতে হয়, বুঝতে হয় কবির ছন্দের স্বতন্ত্র প্রয়োগ এবং তার অন্তর্নিহিত শৈলী। তবে স্বীকার করতেই হয়, আমি ছন্দে খুব পারদর্শী নই, তবু আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকে যদি কবিতাগুলোর সৌন্দর্য ও গঠন সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যায়, তবে সেটাই হবে আমার পরম প্রাপ্তি।

‘বনমাতালের পথে’ কাব‍্যগ্রন্থটি ছন্দের এক বুনো রূপ, যেখানে কবি সুমন শামসুদ্দিন পরিচিত কাঠামোর মধ্যে থেকেও ভাবের মুক্ত প্রবাহ তৈরি করেছেন। প্রতিটি কবিতা ছন্দের এক সংগীতময় বিন্যাস, যা আমাকে এক অন্যরকম আবেশে বুঁদ করে রেখেছে। তবে, বলতেই হয় তাঁর কবিতাগুলোতে বিন্যস্ত ছন্দের শৃঙ্খলা থাকলেও অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কখনোই সীমাবদ্ধ থাকে নি; বরং তা আরও প্রসারিত হয়েছে, প্রতিটি শব্দের মাঝে গুমরে থাকা অদৃশ্য এক আবেগ ধীরে ধীরে স্পন্দিত হয়ে ওঠেছে। 

‘বনমাতালের পথে’-তাঁর প্রথম কবিতা “বাক‍্য স্বাধীনতা”

‘সব শহিদের রক্তবর্ণ হয়ে গেছে কালো

তাইতো এখন স্বপ্ন দেখি-স্বপ্ন দেখাই ভালো

লক্ষফুলে সুশোভিত, শহীদ-মিনার দেখি;

ফেব্রুয়ারি শেষ হলে পর; সব আয়োজন মেকি!’ 

এখানে পঙক্তিগুলোর মাত্রাবিন্যাস ৪/৪/৪/২। অর্থাৎ পর্ব ৪ মাত্রার আর অতি পর্ব ২ মাত্রার। এটি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। 

আরেকটি কবিতা “তুমিশূন‍্য ঘর”-

‘সিলিংএ চৌকাঠে ঘুনপোকার বাসা

টিকটিকিটা একা ঘুরছে

ঘরের চারিদিকে পুরনো আসবাব

যেন পুরনো স্মৃতি পুড়ছে।’

এটি ৭ মাত্রার মাত্রাবৃত্ত কবিতা, সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়লে দেখা যায় যে, চরণের প্রয়োজনে অতিপর্ব  ২/৩ মাত্রায় গড়ে উঠেছে। 

Manual3 Ad Code

সম্পূর্ণ নয় যদি কেবল এই কবিতার প্রথম চারটি চরণের দিকে আলোকপাত করি, তবে বুঝতে পারি, এই কবিতার মাধ্যমে কবি সময়ের অতিক্রম, একাকিত্ব এবং ক্ষয়ের বেদনাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘ঘুনপোকার বাসা’ এবং ‘পুরনো আসবাব’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীর্ণতার প্রতীক। হতে পারে এটি ব্যক্তিগত স্মৃতি কিংবা সমাজের রূপান্তরের দৃষ্টান্ত। ‘টিকটিকিটা একা ঘুরছে’ লাইনটি একাকিত্বের প্রতীক, যা ঘরের নীরবতা ও ফাঁকা পরিবেশের মাধ‍্যমে ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ শূন্যতা প্রকাশ করছে। ‘যেন পুরনো স্মৃতি পুড়ছে’ বাক্যটি স্মৃতির বিলীন হয়ে যাওয়া বা অতীতের কষ্টদায়ক কোনো অভিজ্ঞতাকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলার ইঙ্গিত দিতে পারে। 

স্বরবৃত্তের আরো একটি কবিতা “অনির্দিষ্ট ইচ্ছা”

‘একদিন আমি নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাবো;

গাছেক ডালে বসে দেখবো উদয়-অস্ত’ 

এটা ৪/৪/৪/ মাত্রার স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত। 

Manual5 Ad Code

কবি যে কেবল ছন্দ নিয়েই খেলেন, তা নয়। সংখ‍্যায় কম হলেও মুক্তছন্দ গদ‍্য কবিতাও আমি দেখতে পাই তাঁর সৃষ্টিতে। “অনধীন জন্মভূমি” এমনই একটি কবিতা। 

‘অতঃপর ওরা আমার চোখ বেঁধে ফেললো

পেছনে ঘুরিয়ে বেঁধে ফেললো হাত দুটিও!

এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করা হল-

আমার অন্তিম অভিলাষ!

Manual1 Ad Code

আমি চিৎকার করে বললাম, 

আমি স্বাধীনতা চাই; নইলে মৃত‍্যু।’ 

এই কবিতাটি প্রতীকীভাবে নিপীড়ন, অন্যায় এবং শৃঙ্খলিত অবস্থার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী উচ্চারণকে তুলে ধরছে। বন্দিত্বের মুখোমুখি হয়েও কবি দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বাধীনতাকেই শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেছেন। যদি স্বাধীনতা না মেলে, তবে মৃত্যুই গ্রহণযোগ্য কবির কাছে। প্রতিরোধ ও প্রতিবাদে– অত্যাচারীরা চোখ ও হাত বেঁধে দিলেও চেতনার স্বাধীনতাকে দমন করতে পারেনি-কবির ‘চিৎকার’ তা ই বলে। আমার মনে হয়েছে, এই কবিতাটি, মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা যে-কোনো সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হতে পারে, যেখানে ব্যক্তি তাঁর চূড়ান্ত আত্মত্যাগের আগেও অবিচলভাবে অধিকার ও মুক্তির কথা বলেন। 

Manual6 Ad Code

সুমন শামসুদ্দিন মুক্তছন্দ বা গদ্য কবিতার চেয়ে ছন্দের কবিতাকেই বেশি গুরুত্ব দেন। এবং তাঁর কবিতাগুলোর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার ছন্দের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও প্রতিটি কবিতায় ছন্দের সঠিক প্রয়োগ। কবি প্রথাগত ছন্দের প্রতিটি আঙ্গিক ও তার বাস্তব প্রয়োগে দক্ষতা অর্জন করেছেন, যা ‘বনমাতালের পথে’ গ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠেছে। তাঁর কবিতাগুলোতে ছন্দের ব্যবহার কখনো স্বাভাবিক, কখনো একটু জটিল, মাঝেমাঝে চিরন্তন সত্যের মতো দার্শনিক। তবে সর্বদা সঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর কবিতার লয়, সুর, এবং শব্দের ব্যবহারে গভীর এক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। কবি ছন্দের গঠন ও মাত্রা নিয়ে খেলেন, কখনো সোজা, কখনো বাঁকা পথে চলতে চলতে কবিতাকে এক সুরেলা শব্দ-সমুদ্রের মধ্যে প্রবাহিত করেন। 

সুমন শামসুদ্দিন নিয়মিত ছন্দের উপর প্রশিক্ষণ নেন এবং ছন্দের রীতি ও নিয়ম অনুসরণ করেই কবিতা রচনা করেন। ছন্দের প্রতি তাঁর যে নিবেদন, তা এক অদ্ভুত কবিতার ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে। তাঁর কবিতাগুলোতে ছন্দের সুষমা ও শব্দের সুসমন্বয় পাঠককে এক মগ্নতায় আচ্ছন্ন করে রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি। মোটকথা, ‘বনমাতালের পথে’ একটি ছন্দময় কবিতার সম্ভার, সুমন শামসুদ্দিন কবিতার মাধ্যমে ছন্দের যে মাহাত্ম্য ও শক্তি তুলে ধরেছেন, তা অনেক পাঠককে ছন্দের প্রতিও নতুনভাবে আকৃষ্ট করবে। 

বনমাতালের পথে গ্রন্থের মধ্যে কবি কখনো প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা সহ, কখনো জীবনের জটিল অবস্থা, সমাজের অন‍্যায়, আবার কখনো মানবপ্রকৃতির খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন। তাঁর কবিতায় কল্পনা, বাস্তবতা এবং মানবতার নানা দিক নিখুঁতভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে। এমনকি যেখানে অনুভূতি ও আবেগের গভীরতা রয়েছে, সেখানে সুমন শামসুদ্দিন নিজস্ব ভাষাশৈলী দিয়ে পাঠককে অনুভূতির স্তরে তুলে নিয়েছেন। 

বলে নেয়া ভালো, কবির এই ছন্দের খেলায় কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা, তা নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা আমার নেই। ছন্দের গুরুরা সেটা বলতে পারবেন। তবে ছন্দ সম্পর্কে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের আলোকে যতটা সম্ভব আমি খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি, এবং অবশেষে এক ধারণায় উপনীত হয়েছি যে, সুমন শামসুদ্দিন ছন্দের এক অসাধারণ জাদুকর, যার কবিতার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পঙক্তি ছন্দের এক নিখুঁত সুরে বোনা। কাব্যগ্রন্থ ‘বনমাতালের পথে’ একটি একনিষ্ঠ শিল্পীজীবনের সৃষ্টির ফলস্বরূপ। কবি তাঁর কাব্য শৈলীকে  আধুনিকতার সাথে ঐতিহ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে, কবিতার ভাষাকে নতুন অর্থে প্রকাশ করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। এবং কবিতাগুলোর ছন্দের জাদু সত্যিই এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা পাঠকের মনকে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করবে বলে আশারাখি। কবির জন‍্য শুভ কামনা। 

এইচ বি রিতা ; কবি 

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code