আজ রবিবার, ২৬শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লক্ষণ সেন পদত্যাগ রহস্য

editor
প্রকাশিত মার্চ ১১, ২০২৫, ০৩:২৪ পূর্বাহ্ণ
লক্ষণ সেন পদত্যাগ রহস্য

Sharing is caring!

Manual8 Ad Code

মাসকাওয়াথ আহসান

দাক্ষিণাত্য থেকে বাংলায় এসে পাল বংশকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে সেন বংশ। সেই সেন বংশ কৌলিন্য প্রথা চালু করে। সম্পদ কুক্ষীগত হয় কুলীনদের হাতে। এই ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোককে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তারা অভিজাত ও কুলীন হিসেবে পরিগণিত হন।

Manual1 Ad Code

কুলগ্রন্থ বা কুলজীশাস্ত্র হচ্ছে কৌলিন্য প্রথার আদি ইতিহাস জানার উৎস। অবশ্য রাজার ত্রাণ তহবিলের অর্থ দুঃস্থদের মাঝে বিতরণ করে দানশীলতার সুনাম অর্জন করেন লক্ষণ সেন। তার একটি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ছিল। সেইখানে কবি শরণ, গোবর্ধন, ধোয়ী, জয়দেব লক্ষণ সেনের পিতা বল্লাল সেনকে নিয়ে অনেক প্রশস্তি রচনা করেন। উন্নয়নের জয়গানে তারা বাংলার আকাশ বাতাস মথিত করেন।

এসময় পাল বংশের সমর্থক বৌদ্ধদের ওপর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেন বংশের পৃষ্ঠপোষকতায় কবি-সাহিত্যিকেরা বৌদ্ধদের অপ্রগতিশীল ও জঙ্গী হিসেবে বিবৃতি দিতে থাকে। কবি উমাপতিধর ‘অরিরাজ-নিঃশঙ্কশঙ্কর বল্লাল জন্ম শতবর্ষ’ পালন কর্তা হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। বল্লাল সেন ও লক্ষণ সেনের প্রশংসা গীতি রচনার মাধ্যমে কবি-সাহিত্যিকেরা নিজেরাও গৌড়ে প্লট-পদক ও পদবী পেতে থাকেন। লক্ষণ সেনের রাজসভায় প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি আদলে রচিত হয়, গীতগোবিন্দম। দাক্ষিণাত্য থেকে এলেও বাঙালি সংস্কৃতি চেতনার একমাত্র বিশ্বস্ত মালিক হয়ে পড়েন লক্ষণ সেন।

রাজ্যে জনপ্রিয়তা কমে গেলেও বার্ধক্যজনিত কারণে রাজপ্রাসাদের বাগানে গায়ক-কবি-বিদূষক পরিবেষ্টিত হয়ে লক্ষণ সেন ভাবতেন; এই বাংলায় তার কোনো বিকল্প নাই। তিনি পরমনরসিংহ উপাধি ধারণ করেন। তিনি প্রধান অমাত্য ও প্রধান বিচারপতি হিসেবে হলায়ুধ মিশ্রকে নিয়োগ করেন। নিয়োগ পেয়েই হলায়ুধ লক্ষণ সেনকে পা ছুঁয়ে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে রাজা বলেন, আপনি প্রধান অমাত্য; আপনাকে এ মানায় না। হলায়ুধ বলেন, আশীর্বাদ করুন রাজা, আমি পাটনা থেকে পাবনা ঝড় তুলে ছাড়ব।

লক্ষণ সেন তার আত্মীয় উমাপতিধরকে অমাত্য হিসেবে নিয়োগ দেন এই ভেবে যে, বয়স হয়েছে; উমাপতি নিশ্চিত করবে রুপকল্প ১২২৫ বাস্তবায়ন। সিংহাসন টেকসই হবে উমাপতিধরের অন্ধ আনুগত্যে।

Manual6 Ad Code

কিন্তু রাজ্যের তরুণ সমাজ কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। লক্ষণ সেনের সৈনিকেরা নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে বিপ্লবী তরুণদের। মানবিক গুনের অধিকারী উমাপতি ধর এই তরুণদের হত্যা করতে অস্বীকৃতি জানান। বৌদ্ধ বিহারগুলোতে লক্ষণ সেনের সৈনিকদের নিয়মিত জঙ্গী বিরোধী অভিযানের কারণে বিক্ষুব্ধ বৌদ্ধরা এই তরুণদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়।

১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজি মাত্র কয়েকজন অশ্বারোহী নিয়ে লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করলে কবি গোবর্ধন বলেন, বৌদ্ধ জঙ্গীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে দেখুন হিজবুত জঙ্গী এসে পড়েছে। কবিরা সবাই বিবৃতি দেয়, গৌড়ের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তিদের রুখে দাও।

অমাত্য উমাপতিধর লক্ষণ সেনের প্রাসাদে ঢুকে রাজার কাছে গিয়ে বলেন, আর পয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে; আপনি পদত্যাগ করে পালান। নৌকা প্রস্তুত ঘাটে। লক্ষণ সেন প্রথমে রেগে যান। পরে প্রাসাদের চারপাশে শোরগোল শুনে রাজকীয় রান্নাঘরের পেছন দরজা দিয়ে নৌকা করে বিক্রমপুরে পালিয়ে যান।

উমাপতিধর প্রধান অমাত্য বিচারপতি হলায়ুধ মিশ্রের কাছে গিয়ে লক্ষণ সেনের পদত্যাগ ও পলায়নের কথা জানালে তিনি নীরবে অশ্রুপাত করেন, তুলতে এসেছিলাম ঝড়, ঝরছে বৃষ্টি। নিজেকে সংবরণ করে রাজসভার বাইরে গিয়ে উপস্থিত জনতার সামনে বলেন, রাজা পদত্যাগ করেছেন, আমি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছি।

বিপ্লবীদের সমর্থনে বখতিয়ার খলজি ও তার মন্ত্রীসভাকে শপথ বাক্য পাঠ করান হলায়ুধ মিশ্র। একা হলেই তিনি গাইতে থাকেন, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। দিন রাত্রির ব্যবধান ভুলে যেতে থাকেন; খেয়ে ওঠার পরক্ষণে জিজ্ঞেস করেন, আমি কি আহারাদি সারিয়াছি!

লক্ষণ সেনের সহমত মন্ত্রীসভার কোনো কোনো সদস্য দাড়ি কামিয়ে নৌকা করে বিক্রমপুরে যাবার পথে গ্রেফতার হন। কবিদের বিরুদ্ধে জারী হয় গ্রেফতারি পরোয়ানা। কোনো কোনো সহমত মন্ত্রী সুযোগ সন্ধানী সান্ত্রীদের উপঢৌকন দিয়ে ছদ্মবেশে পালিয়ে যায় বিক্রমপুরে। লক্ষণ সেন তাদের উপদেশ দেয়, বখতিয়ার খলজির বিরুদ্ধে ইতিহাস রচনা করো। আমরা যেসব বৌদ্ধ বিহারে হামলা করে গ্রন্থ পুড়িয়েছি; সে দায় বখতিয়ারের ঘাড়ে দিয়ে দাও। বাংলায় আমরা যে নতুন কুলীন সমাজ তৈরি করেছি, তারা মুখে মুখে বখতিয়ারকে খলনায়ক করে তুলবে; আমি রয়ে যাব নায়ক হিসেবে।

এমন সময় অমর্ত্য সেনকে মনোযোগ দিয়ে কিছু লিখতে দেখে লক্ষণ সেন জিজ্ঞেস করেন, কী লিখিতেছ!

অমর্ত্য সেন উত্তর দেন, বল্লাল সেনের সময়ে বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণা করিতেছি।

লক্ষণ সেন ক্ষমতা হারানোর পর নদীয়ার বাতাস ভারী হয়ে যায়, নব্য কুলীন যারা পতিত হলো, তাদের আফসোস আর কী যে হচ্ছে বিলাপে। নব্য কুলীন নারী চেঁচিয়ে বলে, হ্যাগা শুনইছো তুর্কী তরুণ আমার সঙ্গে প্রেমালাপ জুড়ে দিয়েছিল। আমি বলে দিয়েছি, তুর্কী নারী থাইকতে আমায় হ্যারাজ কইরছ ক্যানে! পরাজিত লক্ষণ সমাজ, চুক চুক করে বলে, দেশটা কী হইয়ে গেল গো! প্রতিদিন রাতে তারা স্বপ্ন দেখে, লক্ষণ সেন ফিরবেন বিজয়ীর বেশে।

এরমধ্যে নানারকম সেন গুজবের মধ্যে গুজব ওঠে, সৈনিকেরা বিদ্রোহ কইরেছে। প্রশাসকেরা কথা শুইনছে না গো। বখতিয়ারের পেছনের শক্তি অটোমান সাম্রাজ্য। বখতিয়ারকে তারা পদক দিয়ে ফুসলিয়ে হেথা পাঠিয়ে দিয়েছে গো।

বিপ্লবী তরুণেরা জিজ্ঞেস করে, ওগো নাটোরের বনলতা সেন, এতদিন কোথায় ছিলেন!

হঠাৎ এক গুঞ্জন ওঠে, হলায়ুধ মিশ্র লক্ষণ সেনের পদত্যাগপত্র খুঁজে পাচ্ছেন না। উনি বাক্স-পেটরা- বালিশ-বিছানা-তোরঙ্গের নীচে খুঁজে হয়রান। বিড় বিড় করে বলছেন, না আমার কাছে পদত্যাগতপত্র নাই। পাটনায় নাকি পাবনায় হারালাম পদত্যাগপত্রখানা কে জানে।

লক্ষণ সেন সমর্থকেরা আশায় বুক বাঁধে, এই বার এই বার লক্ষণ সেন চোখ খুল্লো! গোবর্ধন কুঁচ কুঁচ করে বলে, পদত্যাগ বেআইনি হয়েছে গা। অবশ্য রাজা লক্ষণ সেনের নিয়োগটা বৈধ ছিল।

বিপ্লবী তরুণেরা হলায়ুধ মিশ্রের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়। বখতিয়ারের আইন অমাত্য বলেন, উনি একমুখে ক’রকম কথা বললেন!

হলায়ুধ মিশ্র পাটনায় নথি সংরক্ষণাগারে পদত্যাগপত্র খোঁজেন। না পেয়ে পাবনায় যান, গুন গুন করে গান করেন, চুপি চুপি বলো কেউ ভুলে যাবে। তারপর নদীয়ায় এসে তার মনে পড়ে বিচার বিভাগের ব্যাখ্যার কথা। উনি হেসে বলেন, মীমাংসিত বিষয় নিয়ে অযথা বিতর্ক নয়।

 

Manual2 Ad Code

সূত্র earki

 

Manual4 Ad Code

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code