আজ বৃহস্পতিবার, ৩০শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাকিস্তানীরা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায় : অলি আহমদ

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪, ০৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ

Sharing is caring!

Manual5 Ad Code

টাইমস নিউজ 

মহান বিজয় দিবসের স্মৃতি রোমন্থন করে সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তিনি জেড ফোর্স ও প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে সিলেটে ছিলেন।

শনিবার রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএসের বাসভবনে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমদ আরও বলেন, ‘বিজয়ের দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর সিলেট শত্রুমুক্ত করি। পাকিস্তান সেনাদল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ তারা মনে করেছিল হয়তো মুক্তিযোদ্ধারা জেনেভা কনভেনশন মানবে না। অতএব ভারতের সেনাদলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।’

অলি আহমদ বলেন, ১৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানসহ সিলেটে একটি চা বাগানের জঙ্গলে অবস্থান করেছিলাম।বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম আনন্দঘন দিন ১৬ ডিসেম্বর উল্লেখ করে ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বলেন, ‘৯ মাস রক্তস্নাত স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে আমরা পাই মহান বিজয়। পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার জয়- আনন্দ গৌরবের। আমরা সেই দিন খুব আনন্দিত হয়েছি। স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।’

‘১৯৭১ সালে আমি ছিলাম চট্টগ্রামে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কর্মরত তরুণ এক অফিসার’- একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্য হয়েও জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।

অলি আহমদ বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করে অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই রোমহর্ষক। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমি সর্বপ্রথম অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। সে সময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল আব্দুর রশিদ জানজুয়া এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

Manual1 Ad Code

তিনি বলেন, ‘২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পটিয়া থানায় বসে আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমি জিয়াউর রহমানকে বললাম, আপনি রেডিও স্টেশনে চলে যান। তাকে আমি গার্ড দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে। এটা ছিল ট্রান্সমিটিং স্টেশন। এটাকে কিছুটা পরিবর্তন করে ব্রডকাস্টিং স্টেশন করা হয়।

Manual8 Ad Code

সেখানে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, আই মেজর জিয়া ডিক্লেয়ার মাইসেল্ফ অ্যাজ প্রভিশনাল হেড অব দ্য স্টেট অ্যান্ড আর্জ অল দ্য কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড টু সাপোর্ট আস। অর্থাৎ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করলাম এবং বিশ্বের সব দেশকে আমাদের স্বীকৃতি, অস্ত্র, খাদ্য, ওষুধ দেওয়ার অনুরোধ জানালাম। ৩০ মে সন্ধ্যায় তিনি আরেকটি ঘোষণা দেন।

এতে তিনি বলেন, ‘আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা হস্তান্তর করলাম এবং নিজেকে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করলাম। জিয়াউর রহমান যখন স্বাধীনতার ঘোষণা করেন, তখন আমি পাশে বসে ছিলাম। ১৯৭৩ সালে জিয়াউর রহমানের নিজ হাতে লেখা একটি ডক্যুমেন্ট আছে আমার কাছে। তিনি লিখেছেন, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ বিদ্রোহের জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।’

Manual1 Ad Code

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করে অলি আহমদ বলেন, ‘২৭ মার্চ সকালে জিয়াউর রহমান ও আমি পটিয়া থানায় উপস্থিত হই। ওই জায়গায় আসেন জনাব মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি। প্রায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি লম্বা। তিনি থানার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বললেন, এখানে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ কে? আমাদের কাঁধে কোন ব্যাচ ছিলো না। শুধু খাকি ইউনিফর্ম পরা ছিল। আমি তাকে থানার বারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলাম। আপনি ক্যাপ্টেন অলিকে কেনো তালাশ করছেন? তিনি উত্তরে বললেন, ক্যাপ্টেন অলিকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হবে। কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, অলি আহমদ চট্টগ্রামের সন্তান। তিনি যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তাহলে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসবেন।

জবাবে আমি বললাম, কক্ষের ভেতরে যিনি বসে আছেন- উনি হলেন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এরপর মেজর জিয়ার সাথে আমার এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজর জিয়াউর রহমান জনাব মাহমুদকে সাথে নিয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আমি মেজর জিয়াকে বললাম বোয়ালখালী থানার ফুলতলা প্রাইমারি স্কুলে আমি আর্মি হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে কিছুক্ষণের মধ্যেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত হব। আমি উপস্থিত হওয়ার পূর্বেই তৎকালীন মেজর জিয়া বেতার ভাষণের জন্য বিষয়বস্তু লিপিবদ্ধ করেন। আমি উপস্থিত হয়ে দু’টি সংশোধনী করলাম। জিয়াউর রহমান সংশোধনীগুলো গ্রহণ করলেন।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য অলি আহমদ বলেন, ‘মূলত জিয়াউর রহমানের এই ভাষণ ছিল সমগ্র জাতির ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য এক দিক-নির্দেশনা। জাতি কখনো তার এ সাহসী ভূমিকার কথা ভুলবে না। এরপর সমগ্র চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়। তবে এ যুদ্ধ আওয়ামী লীগের মধ্যম সারি বা উচ্চ সারির কোন নেতা সম্পৃক্ত ছিল না। পরে আমরা জানতে পারলাম শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্রণোদিত হয়ে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানিদের হাতে আত্মসমর্পণ করেন। দীর্ঘ নয় মাস আমরা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি।’

যুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরে অলি আহমদ বলেন, ‘১৩ এপ্রিল রাতে মেজর জিয়া আমাকে মিরসরাইয়ে যেতে বলেন এবং ঢাকা চট্টগ্রামমুখী শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা পেয়ে সকালেই রামগড় থেকে ৩৫ মাইল দূরে মিরসরাইয়ে এসে উপস্থিত হই। এ সময় আমার সঙ্গে ছিল দুই প্লাটুন প্রাক্তন ইপিআর সদস্য এবং এক প্লাটুন নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি তিন ইঞ্চি মর্টার, একটি মেশিনগান আর একটি ৭৫ মিলিমিটার-ট্যাংক বিধ্বংসী ছোট কামান। আমরা যুদ্ধে গেরিলা কৌশল অবলম্বন করলাম। গোপনে রাস্তায় দুই পাশে বাংকার তৈরি করে ওই জায়গায় পৃথক পরপর ৩টি অবস্থানে পাক সেনাবাহিনীর অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর শত্রুবাহিনীকে আমাদের পাতা ফাঁদে ফেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।’

অপারেশন মিরসরাইয়ের স্মৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘১৯ এপ্রিল ভোরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে আমি নায়েক ফয়েজ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম, প্লাটুন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও প্লাটুন হাবিলদার স্ব স্ব বাংকারে নেই। খবর দিয়ে দ্রুত তাদের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রস্তুতি শেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কে উঠেই চমকে গেলাম। দেখলাম, একটি মাইক্রোবাস আসছে। তার একটু পেছনে একটি সাধারণ ৩ টনি ট্রাক। তার একটু পেছনেই সারিবদ্ধভাবে আসছে ২০টি সামরিক ট্রাকের বহর। প্রতিটিই সৈন্যবাহী ট্রাক। আমি দ্রুত আড়াল নিলাম।’

Manual7 Ad Code

পুরো শত্রুবাহিনী তাদের অবস্থানে ঢুকে পড়তেই তিনি ফায়ার ওপেন করলেন উল্লেখ করে অপারেশন মিরসরাইয় সম্পর্কে আরও বলেন, ‘দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ধার করা ৭৫ মিলিমিটার-বিধ্বংসী কামান দিয়ে আমি সবচেয়ে পেছনের ট্রাকটি ধ্বংস করে দিই। হাবিলদার সিদ্দিক মর্টার ফায়ার করে সামনে ও মাঝখানের তিনটি সামরিক ট্রাক উড়িয়ে দেন। অধিকাংশ শত্রুসেনা নিজ গাড়ির মধ্যেই নিহত হয়।’

অলি আহমদ বলেন, ‘আমার কোম্পানি সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শত্রুসেনাদের মিরসরাইয়ে আটকে রাখে। এর মধ্যে ইপিআরের আরেকটি প্লাটুন সুবেদার সাইদুলের নেতৃত্বে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ২য় অবস্থানে থাকা হাবিলদার সিদ্দিক শত্রুবাহিনীর গুলিতে আহত হন। ল্যান্সনায়েক আবুল কালামও অতর্কিত এক মর্টার শেলের আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এ সময় আরও চারজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তবে আমরা এ যুদ্ধে ১২০ জন শত্রুসেনাকে খতম করি এবং তাদের আটটি সামরিক যান ধ্বংস করে দিই, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করেন।’

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code