Sharing is caring!
সৌমিত্র দেব
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলছে । সেই সময় ১৮ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জরুরি ভাবে গুরুত্বপূর্ণ নেতা কর্মীদের নিয়ে বসলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । তিনি তাদেরকে কলকাতার একটা ঠিকানা মুখস্ত করালেন । বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানীরা যদি বেশী ঝামেলা করে , আমি তোমাদের সঙ্গে নাও থাকতে পারি , তোমরা ভারতে গিয়ে এই ঠিকানায় যোগাযোগ করবে । সেখানে আছেন আমার বিশ্বস্ত মানুষ চিত্তরঞ্জন সুতার । তিনি তোমাদের সহযোগিতা করবেন ।
তারপর উত্তাল মার্চ মাস । সত্যি সত্যি গ্রেফতার হলেন বঙ্গবন্ধু। ২৫ মার্চ চালানো হলো গণহত্যা। আওয়ামী লীগ নেতারা চলে গেলেন ভারতে । কিন্তু কার সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করবেন? তারা যোগাযোগ করলেন সেই ঠিকানায়। চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে । চিত্ত তাদের আশ্রয় দিলেন । তারপর এই রহস্যময় মানুষের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হলেন তাজউদ্দিন আহমেদ । আওয়ামীলীগ নেতাদের পক্ষ নিয়ে দিল্লীর হাই কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তিনি। গঠিত হলো প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার । ধীরে ধীরে সবাই জানলেন , চিত্ত ভারতীয় নন। তিনি বাংলাদেশের বরিশালের সন্তান। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সংখ্যালঘু আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন । ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ স্বাধীন করার মিশন নিয়ে চলে গেছেন কলকাতায়। যোগাযোগ রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস চিত্ত সুতার ও তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন । প্রবাসী সরকারের সব কিছুতেই ছায়ার মতো জড়িয়ে ছিল এই পরিবার।
দেশ স্বাধীনের পরে দেশে ফিরেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্তরঞ্জন সুতার ।
১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।[৩] তিনি বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মনোনীত সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ১১ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ভারতে যাওয়ার পর আর কখনও বাংলাদেশে ফিরে আসেননি।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
চিত্তরঞ্জন সুতার ২৩ মার্চ ১৯২৮ সালে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি (নেছারাবাদ) উপজেলার বাটনাতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ললিত কুমার সুতার ও মাতা বেলোকা সুন্দরী। তিনি মঞ্জুশ্রী সেনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির একটি মাত্র সন্তান বাপী সুতার কলিকাতার ভবানীপুরে বসবাস করছেন। তিনি বিএম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।
রাজনৈতিক ও কর্মজীবন
চিত্তরঞ্জন সুতার দেশভাগের সময় কলকাতায় ছিলেন। দলিত শ্রেনীর মানুষ হলেও তফসিলী নেতা যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের রাজনীতির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন বলে জানা যায় না ।
এ সময় পূর্ববঙ্গ ত্যাগী অসংখ্য হিন্দু বাস্তুহারা আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে। সেখানে শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থানকালে বাস্তুত্যাগী এ হিন্দুরা “রিলিফ মঙ্গার” বা ত্রাণনির্ভর হয়ে ওঠায় তারা ক্রমেই অলস শ্রেণীতে পরিণত হতে থাকেন। তাস-পাশা খেলে দিনাতিপাত করায় তাদের এ অবস্থা তরুন চিত্ত সুতারকে ব্যথিত ও চিন্তিত করে তোলে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, এভাবে ভারতে এই শরণার্থীরা ক্রমান্বয়ে একটি কর্মহীন ভবঘুরে শ্রেণীতে দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এক পর্যায়ে বিলুপ্ত গোষ্ঠী হয়ে সমাজ থেকে হারিয়ে যাবে। এই ধারণা থেকে প্রসূত বিশেষ ভাবনা তাঁকে পুনরায় নিজ জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনে এবং গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যাপৃত হতে উত্সাহিত করে। ভূস্বামী পিতার বিত্ত-বৈভব তাঁকে নতুন চিন্তা বাস্তবায়নে প্রেরণা যোগায়। পিতার একমাত্র উত্তরাধিকার চিত্তসুতার আনন্দ চিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বজাতির মুক্তির কাজে। ৪৭ সালের পর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাটনাতলা হাইস্কুল পুনর্গঠিত করে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হন এবং তফশিলভুক্ত হিন্দুদের সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করতে শুরু করেন। একই সাথে নিজ গ্রামে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করেন। এ দু’টি বিদ্যালয়কে কেন্দ করে তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনারও চিন্তা-ভাবনা করতেন। এক পর্যায় কমিউনিস্ট রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে হিন্দু সংরক্ষিত আসন থেকে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হন। প্রকাশ এ নির্বাচনের সময় স্কুল সার্টিফিকেট অনুযায়ী তাঁর বয়স ২৫ বছর হয়নি। হিন্দুদের “কুষ্টিনামা” বলে তিনি প্রার্থিতার ক্ষেত্রে বয়সের অযোগ্যতা দূর করেছিলেন। জানা যায়, তিনি যে এ নির্বাচনে অংশ নেবেন তা নির্ধারিত হয়েছিল ৫৩ সালে পিরোজপুর থানার সিকদার মল্লিক ইউনিয়নের চালিতাখালী গ্রামের সতীশ মলঙ্গির (মজুমদার) বাড়িতে একটি বৈঠকে আগ্রহী হিন্দু নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে। যুক্তফ্রন্টের সময় প্রাদেশিক আইন পরিষদে বিভিন্ন সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। পাশাপাশি কৃষকদের সংগঠিত করেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করলে চিত্ত সুতার সে দলে যোগ দেন । ৫৮ সালে আইয়ূব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করার পর তাঁকে কারাবন্দী করা হয়। ৬০’র দশকে বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁকে তত্পর দেখা যায়। এক পর্যায়ে ন্যাপের রাজনীতি পরিত্যাগ করে তিনি আবার ভারতে চলে যান। মাঝে মাঝে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে অতি গোপনে আসা-যাওয়া করতেন। ভারতে অবস্থানকালে এস বি রায় বা সত্যব্রত রায় ছদ্মনামে তিনি কলিকাতায় দু’বাংলার অনুসারীদের যোগাযোগে রাজনৈতিক তত্পরতায় লিপ্ত ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু’র ৬ দফা আন্দোলন, “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” মোকাবেলা ও গ্রেফতার, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন ইত্যাদি বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন চলছিল। চিত্ত সুতার কলিকাতায় অবস্থান করেও এ রাজনৈতিক আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু’র অন্যতম পরামর্শদাতা বা সংগঠক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন। ৭০ সালের নির্বাচনের আগে তিনি দেশে ফিরে এসে গণমুক্তি দল নামে নিজস্ব চিন্তাধারা বাস্তবায়নের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন নিজে নেপথ্যে থেকে। যে দলের সভাপতি হন নাজিরপুর থানার সামন্তগাতী গ্রামের ঢাকা প্রবাসী ডাঃ কালীদাস বৈদ্য। এ নির্বাচনে ডা. বৈদ্য মোমবাতি প্রতীকে স্বরূপকাঠি-নাজিরপুর-বানারীপাড়া জাতীয় পরিষদ আসনে ৪০ হাজার ভোট পেয়ে সংগঠনটির শক্তি প্রদর্শন করেন। বঙ্গবন্ধুর নৌকা আর শেরে বাংলার ইমেজের পাল্টা গণমুক্তির মোমবাতি মার্কার এ বিপুল ভোট প্রাপ্তি তখন রাজনৈতিক মহলকে বেশ ভাবনায় ফেলেছিল। উল্লেখ্য, তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে শেরে বাংলা পুত্র এ কে ফায়জুল হক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ নির্বাচনে এ দলটির যে ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল তা পরবর্তীকালে ৭২ সালের স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রতিফলন ঘটেছে বলে এ প্রতিবেদনের তথ্য দাতা উক্ত সংগঠনের তত্কালীন অন্যতম সংগঠক অবসর জীবনযাপনকারী এ প্রধান শিক্ষকের দাবি। নির্বাচনের পরপরই চিত্তরঞ্জন সুতার আবার ভারতে চলে যান। আরও জানা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সাথে ভারতের রাজনীতিবিদ, দিল্লী ও কলিকাতা সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলের সাথে যোগাযোগের বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময় কলিকাতার ভবানীপুরের সানি ভিলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে বসবাসের জন্য বরাদ্দ করা ছিল এবং বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক রাজনীতিবিদদের মূল আড্ডা বসত এখানে। দেশ মুক্ত হওয়ার পর ৭৩ সালের প্রথম দিকে চিত্ত সুতার দেশে ফিরে আসেন এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি—বানারীপাড়া সংসদীয় আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তিনি বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও মনোনীত সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ১১ আগস্ট ১৯৭৫ সালে ভারতে যাওয়ার পর আর কখনও বাংলাদেশে ফিরে আসেননি।
অন্যান্য কর্ম
তিনি তার জন্মস্থান বাটনাতলায় ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত “জন সম্মিলনী প্রবেশিকা বালিকা বিদ্যালয়” এর প্রতিষ্ঠাতা।
বিতর্ক
১৯৫১ সালের শেষদিকে তিনি পূর্বপাকিস্তানে প্রবেশ করেন। সাথে ছিলেন কালিদাস বৈদ্য ও নিরোধ মজুমদার। তিনি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (R&AW) এর কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে ভবানীপুরের ২৬ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ সড়কে বাস করতেন। ভারতীয় পাসপোর্টে তার নাম ভুজঙ্গ ভূষন রায়।
তাছাড়া তিনি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে হিন্দু রাজ্যে পরিণত করার জন্য “স্বাধীন বঙ্গভূমি” নামে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এই আন্দোলনে তার নাম হচ্ছে পার্থ সামন্ত।
এ ব্যাপারে ইনকিলাব পত্রিকায় এক কলামে প্রবীণ সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরী লিখেছেন, আমি ডা. কালীদাস বৈদ্যের নাম জানলেও তার সঙ্গে আমার কোনো দিন দেখা হয়নি। যতদূর মনে পড়ে অবিভক্ত পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে চিত্তরঞ্জন সুতার, ডা. কালীদাস বৈদ্য, মলয় কুমার ভৌমিকসহ আরও কয়েকজন মিলে ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে একটি হিন্দু সম্মেলন ডেকে মূলত তফসিলি হিন্দুদের নিয়ে জাতীয় গণমুক্তি দল নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। দেশের এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে শুধু হিন্দুদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা অদৌ সঙ্গত হবে কিনা তা নিয়ে সম্মেলনে তুমুল বিতর্ক হয়। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপ্লবী অতীশ রায়, অ্যাডভোকেট সুধীর হাজরা প্রমুখ হিন্দু দল গঠনের তীব্র বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় গণমুক্তি দল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসনে প্রার্থী দিয়ে একটাতেও জিততে পারেনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৃশ্যত এই দলের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় গণমুক্তি দল ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে একপর্যায়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ সময় এই দলের দুই কান্ডারি চিত্তরঞ্জন সুতার এবং কালীদাস বৈদ্য কলকাতায় অবস্থান করতে থাকেন; যদিও তারা মাঝে-মধ্যে বাংলাদেশে আসতেন। একপর্যায়ে চিত্তরঞ্জন সুতার জাতীয় গণমুক্তি দলের মায়া পরিত্যাগ করে ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর তারা আর বাংলাদেশে আসেননি। এরপর থেকে চিত্তরঞ্জন সুতারের নাম তেমন একটা শোনা না গেলেও স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন গড়ে তোলে কালীদাস বৈদ্য পাদপ্রদীপে চলে আসেন।
মৃত্যু
চিত্তরঞ্জন সুতার ২৭ নভেম্বর ২০০২ ভারতের রাজধানী দিল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন।