আজ সোমবার, ২০শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম, শঙ্কায় শিল্পমালিকরা

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৪, ২০২৫, ০৬:৩০ পূর্বাহ্ণ
বাড়ছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম, শঙ্কায় শিল্পমালিকরা

Sharing is caring!

Manual7 Ad Code

 

নাগরিক জীবনে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এগুলো মানুষের মৌলিক জনপরিষেবা। এদিকে শিল্পক্ষেত্রে গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার ছাড়া আমরা আর কিছু চিন্তাই করতে পারি না। গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে এক প্রকার অস্থিরতা চলছে।

সরকারের ভুলনীতির কারণে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ৭টি কোম্পানি আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত কেউ দরপত্রে অংশ নেয়নি। বেসরকারি প্রকল্পে ‘বাস্তবায়ন চুক্তি বা ইমপ্লিমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ)’ বাতিল করা হয়েছে। এতে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে গ্রাহক পর্যায়ে দামও বাড়বে।এদিকে পিডিবি তিন অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে যাচ্ছে। ফলে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে বিগত সরকারের সাগর চুরির খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে শিল্পখাতে দাম বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন খাতের ট্যাক্স বাড়াতে হচ্ছে—এমন মন্তব্য করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন।

সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তে নানা শঙ্কায় ভুগছেন শিল্পমালিকরা। শিল্পকারখানা ও ক্যাপটিভে গ্যাসের নতুন সংযোগের দাম দ্বিগুণ করার পর এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। জ্বালানি বিভাগ জানিয়েছে, আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যা পড়বে, সেই দর অনুযায়ী নতুন শিল্পকারখানার মালিকদের কাছ থেকে গ্যাসের দাম আদায় করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়তে পারে দ্বিগুণের বেশি।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। এটি বাস্তবায়ন হলে ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের শিল্প খাত। নতুন করে কেউ কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়তে চাইবে না। এক দেশে দুই আইন থাকলে শিল্প খাতে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা। এদিকে গ্যাসের দাম নিয়ে সমস্যার সমাধান না করে নতুন করে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে পারে-এমন আরও একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার।

জানা যায়, বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি প্রকল্পে ‘বাস্তবায়ন চুক্তি বা ইমপ্লিমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ)’ বাতিল করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের কারণেও বিদ্যুৎ খাতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইএ বাতিল হলে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বিনিয়োগকে তারা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করবে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও সক্ষমতা বিবেচনায় ঋণ সহায়তা দেবে না। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বাস্তবায়নকারী কোম্পানির ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে দাম বাড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এ বাড়তি ব্যয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে যোগ হয়ে গ্রাহকের কাঁধে পড়বে।

বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপা) সভাপতি কেএম রেজাউল হাসনাত বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ সচিবকে একটি চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি বলেছেন, আইএ বিধান থাকার ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশে বিনিয়োগে উৎসাহী ছিলেন। এখন তারা নিরুৎসাহিত হবেন। দেশীয় বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। চিঠিতে তিনি এটি বহাল রাখার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান।

Manual5 Ad Code

বিদ্যুৎ প্রকল্পে ‘বাস্তবায়ন চুক্তি বা ইমপ্লিমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ)’ হচ্ছে বিনিয়োগের ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌম গ্যারান্টির মতো। এটি মূলত বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির (পিপিএ) সম্পূরক চুক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আইএ থাকার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পায়। আর বাস্তবায়নকারী কোম্পানি স্বল্পসুদে ঋণসহ দাতা সংস্থা থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে থাকে। সম্প্রতি ১০ সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আহ্বান করা দরপত্রে আইএ বিধান বাতিল করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বাতিল হওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে গ্রাহক পর্যায়ে দামও বাড়বে। এছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান বেড়ে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা, অ্যাঙ্গোলা, সেনেগালের মতো দেশগুলোর বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তির (পিপিএ) সম্পূরক চুক্তি হিসাবে আইএ করার বিধান রয়েছে। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বেসরকারি খাতে যত বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সবকটিতেই আইএ ছিল। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) গেল বছরের ৫ ডিসেম্বর আইএ বিধান ছাড়া ৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। পরে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ৫০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরও ১০টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও চালু হওয়ার পর সরকার ২০ বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট দামে বিদ্যুৎ কিনতে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষর করবে। ৭ জানুয়ারি বিদ্যুৎ সচিবের সঙ্গে এক বৈঠকে উদ্যোক্তারা গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া নানা অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা বলেছেন, আইএ বাতিল করায় বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলোর জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী পাওয়া যাবে না।

Manual4 Ad Code

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অবশ্য বলেছে, সরকার ইচ্ছা করেই আইএ বাতিল করেনি। এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে গেছে। পিডিবি চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বিশেষ আইনটি বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে বাস্তবায়ন চুক্তিও (আইএ) বাতিল হয়ে গেছে। তবে যেসব কোম্পানি ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করে ফেলেছে, তারা তো উৎপাদন করছেই। নতুন করে কেউ যদি বিনিয়োগ করতে চায়, তাদেরও আমরা উৎসাহিত করব। খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আইএ বিধান বাদ দেওয়ার কারণে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময়ই বিনিয়োগকারীদের ব্যয় বেশি দেখাবে। ফলে যে কোম্পানিই কাজ পাক না কেন, দাম বেশি হবেই। এ কারণে বিপাকে পড়বে পিডিবি। বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করতে হবে। এতে লোকসান বাড়বে, ভর্তুকিও বাড়বে।

Manual7 Ad Code

জানা যায়, পিডিবি তিন অর্থবছরে ধারাবাহিকভাবে লোকসান করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা লোকসান করেছে। বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকরা পিডিবির কাছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। পিডিবির আর্থিক সংকটের কারণে এ টাকা পরিশোধ করতে পারছে না।

বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আল মাহমুদ বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। আর উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে উদ্যোক্তারা দাম বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেবেন।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকারের ভুলনীতির কারণে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ৭টি কোম্পানি আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত কেউ দরপত্রে অংশ নেয়নি। এখন বিদ্যুৎ খাতেও সরকার একই ধরনের ভুল করছে।

Manual3 Ad Code

৩০ টাকার গ্যাস ৭৫ টাকা করার প্রস্তাব পেট্রোবাংলার : নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিনগুণ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম বৃহৎ শিল্পে ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। ক্যাপটিভে ১৬ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়। এরপর গত বছর ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটে আরও ৭৫ পয়সা দাম বাড়ানো হয়। তবে দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। এ অবস্থায় সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলে আবারও গ্যাসের দাম আড়াই গুণ বাড়াতে চায় সরকার। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে পেট্রোবাংলার পাঠানো প্রস্তাবনায় প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এ সিদ্ধান্ত নতুন শিল্পকারখানার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে।

শিল্পমালিকরা বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে দেশের চলমান শিল্পোন্নয়ন থমকে যাবে। এ খাতে চরম অস্থিরতা দেখা দেবে। এক দেশে দুই আইন কেউ মেনে নেবে না। কেউ ৩০ টাকা হারে গ্যাসের দাম দেবে আবার কেউ ৭৫ টাকা হারে গ্যাসের দাম দেবে, এটা কেউ মানবে না।

যদিও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেছেন, এখন থেকে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি ছাড়া কারও কাজ পাওয়ার সুযোগ নেই। তাই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আগের সরকার নানামুখী সুবিধা নিয়ে ঢালাওভাবে কাজ দিয়েছে কোম্পানিগুলোকে। আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। নতুন সিদ্ধান্তেও বিনিয়োগকারীরা আসবে বলেই আমরা বিশ্বাস করি। এতে উৎপাদন খরচ বাড়লেও তেমন একটা প্রভাব পড়বে না।

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code