আজ বৃহস্পতিবার, ১৩ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপানো ২০২৫ : দেড় হাজার কোটি টাকা দুই সিন্ডিকেটের পকেটে

editor
প্রকাশিত মে ৫, ২০২৫, ১০:১৮ পূর্বাহ্ণ
বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপানো ২০২৫ : দেড় হাজার কোটি টাকা দুই সিন্ডিকেটের পকেটে

Oplus_16908288

Sharing is caring!

Manual6 Ad Code
সিনিয়র প্রতিবেদকঃ
চলতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ৩৯ কোটি ৬০ লাখ বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ঘিরে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট করেছে দুই সিন্ডিকেট।
 ছাপাখানাগুলোর ‘সিন্ডিকেট দরে’ সরকারের অতিরিক্ত গচ্চা গেছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কাগজের দাম বাড়িয়ে ৩৪৫ কোটি টাকা হাতিয়েছেন কাগজ মিল মালিকরা।
অন্যদিকে এক শ্রেণীর ছাপাখানা নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই ছাপিয়ে সরবরাহ করেছে, যা মোট পাঠ্যবইয়ের প্রায় ২০ ভাগ। এর মাধ্যমে ৩৫৫ কোটি টাকার অধিক মুনাফা অর্জন করেছেন ওই সব মুদ্রাকররা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তা ও ছাপাখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এবং অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, এনসিটিবি কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও বিগত সরকারের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণকারীদের ষড়যন্ত্রে সিন্ডিকেটের সদস্যরা এই অর্থ লোপাট করার সুযোগ পেয়েছে। বিগত সরকারের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণকারীরা এখনো এনসিটিবিতে বহাল তবিয়তে আছেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।
এবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি দর দিয়ে প্রেস মালিকরা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী বই ছাপার কাজ বাগিয়ে নেন।
প্রতিটি প্রেস মালিকরা প্রাক্কলিত ব্যয়ের থেকে ১৯ দশমিক ১, ১৯ দশমিক ২ কিংবা ২০ শতাংশ বাড়িয়ে টেন্ডার জমা দেয়। প্রায় ৪০ ভাগ টেন্ডারে একজনের বেশি টেন্ডার জমা দেয়নি।
এনসিটিবি সূত্র বলছে, স্বল্প সময়ে কাজের চাপ বেশি থাকার সুযোগ নিয়েছে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট। ফলে সিন্ডিকেট সম্পর্কে বুঝতে পারলেও দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি এনসিটিবি।
যদিও প্রেস মালিক কর্তৃপক্ষের দাবি, বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় তাদের তেমন করণীয় ছিল না। জানা গেছে, বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ করে যেসব প্রেস (ছাপাখানা), সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান মালিকই সাবেক সরকারের সময়ে সিন্ডিকেট করে দরপত্রে কম দর দিয়ে বইয়ের কাজ বাগিয়ে নিতেন।
এরপর দিতেন নিম্নমানের কাগজের বই। কিন্তু অজানা কারণে তারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু প্রেস মালিক অবশ্য এই সিন্ডিকেটের বাইরে ছিলেন। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব প্রেস মালিকই একজোট হয়ে যান।
 বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবি অনুমোদিত প্রেস রয়েছে ১১৬টি। গত বছর যেখানে নতুন পাঠ্যবই বাবদ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এবার সেখানে ২ হাজার কোটির বেশি খরচ হয়েছে।
বর্তমানে এনসিটিবির নিয়মিত চেয়ারম্যান নেই। সম্প্রতি অবসরে গেছেন এতদিন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
 চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অধ্যাপক একেএম রিয়াজুল হাসান ইত্তেফাককে বলেছিলেন, প্রেস মালিকরা এবার সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছেন।
যেহেতু আমাদের সময় কম, ফের দরপত্র করার মতোও পর্যাপ্ত সময় নেই। যে কারণে প্রতিটি শ্রেণিতে ২০ শতাংশের মতো বেশি দামে কাজ দিতে হয়েছে। ফলে আমাদের ধারণার চেয়ে প্রায় ৭৮৩ কোটি টাকা বেশি দিতে হয়েছে। এছাড়া পুরোনো কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার ফলে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনেকগুলো পরিবর্তন এসেছে।
আগে দশম শ্রেণির বই দেওয়া হতো না, কিন্তু এবার সেটাও দিতে হয়েছে। ফলে এখানে নতুন করে প্রায় ৬ কোটি ৪৪ লক্ষ বই বেশি ছাপতে হয়েছে। আবার বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, কারিকুলাম পরিবর্তনের কারণে আমাদের কাজের পরিধি বাড়লেও সময়ের স্বল্পতা ছিল।
তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দরে কাজ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলেন, এনসিটিবি নিজেদের মতো করে একটা প্রাক্কলিত দর ঠিক করে। আগের বছরগুলোয় যে দর ছিল, একই দরে এ বছরও প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করেছে। এটি বাস্তবসম্মত নয়।
 ফলে তাদের নির্ধারিত দরে কাজ করা সম্ভব হয় না। আবার এ বছর কাগজসহ ছাপার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের দাম, ব্যাংক ঋণের হার ও ট্যাক্সের পরিমাণ গতবারের তুলনায় অনেক বেশি। স্বল্প সময়ে অধিক বই মুদ্রণের ফলে আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দর আগের চেয়ে বেড়েছে। এখানে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটের বিষয় নেই।
এদিকে টেন্ডারের সব শর্ত মেনে পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি নিলেও কাগজের পুরুত্ব (মোটা), ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) ও টেকসই ক্ষমতা (বার্স্টিং ফ্যাক্টর) কিছুই মানা হয়নি প্রায় ২০ ভাগ পাঠ্যবইয়ে। জানা গেছে, নিম্নমানের কাগজে বই ছাপতে গিয়ে গত ৫ ডিসেম্বর হাতেনাতে ধরা পড়ে দুটি প্রেস। এছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট প্রেসগুলো নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই বেশি ছাপিয়েছে।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ‘নিম্নমানের কাগজের বিষয়ে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের অর্থ ছাড় বন্ধ রাখা হয়েছিল। এছাড়া নির্ধারিত সময়ে বই না দেওয়ার কারণে এবার ২৬টি ছাপাখানা কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।
 পরবর্তীতে অজানা কারণে বিলও ছাড় দেওয়া হয়েছে, কালো তালিকাভুক্ত থেকেও মুক্তি পেয়েছে।’ এদিকে এবার বিশেষ ব্যবস্থায় কাগজ আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশ খোলা বাজারে বিক্রি করে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়েছে এক শ্রেণীর ছাপাখানার মালিক।
ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকলো কাগজের মূল্য বৃদ্ধির সিন্ডিকেট: কাগজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবার হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৩৪৫ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের মূল্য বাড়েনি।
তারপরও চলতি বছর দেশের কাগজের মিল মালিকরা পাঠ্যবই ছাপানোর মৌসুমে দফায় দফায় বৃদ্ধি করে কাগজের মূল্য। গত ডিসেম্বরে হঠাৎ করে প্রতি টন কাগজের মূল্য বাড়ে ৩০ হাজার টাকা। ৩৯ কোটি ৬০ লাখের বেশি পাঠ্যবই ছাপাতে প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার টন কাগজ।
সেই হিসাবে কাগজ মিলের মালিকরা ঐ বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেন। আবার বেশি দাম দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পায়নি পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা দেশের ১১৬ ছাপাখানা। এ কারণে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। কাগজ সংকটের কারণে অধিকাংশ ছাপাখানা টানা তিন মাস প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা ছাপা বন্ধ রেখেছিল।
কাগজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্রও ছিল। কাগজের মিল মালিকদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে সরকারকে কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ১০টি ছাপাখানার মালিক।
এবার কাগজ আমদানি নিয়ে ‘ত্রিমুখী’ অবস্থান: ‘শুল্কমুক্ত কাগজ’ আমদানির সুযোগ চেয়ে গত ২০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে ‘বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির’ পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেয়া হয়।
 চিঠিতে ‘শুল্কমুক্ত কাগজ, আট কার্ড আমদানির সুবিধা প্রদান’ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘এনসিটিবির প্রত্যায়নের ভিত্তিতে শুধু কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং যে সব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সরাসরি মুদ্রণ কাগজ আমদানি করতে পারে না তাদের জন্য এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে আমদানিকারক নিযুক্ত করে শুল্কমুক্ত কাগজ ও আট কার্ড আমদানি করে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপার সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখার বিনীত অনুরোধ করছি।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘২০২৫ শিক্ষাবর্ষের ন্যায় ২০২৬ শিক্ষাবর্ষেও আমদানিকারকদের পাশাপাশি এনসিটিবির কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য শুল্কমুক্ত কাগজ ও আর্ট কার্ড আমদানি সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে আমরা মনে করি।’
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হলে কাগজের ‘সংকট’ হয়।
 এজন্য এবার কিছু কাগজ আমদানি করা হয়েছে। তবে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার সময় সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কিনা, সেই বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code